দিল্লি সুলতানাত যুগ (১২০৬-১৫২৬ খ্রি.)

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (পুরোনো সংস্করণ) - ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র | | NCTB BOOK

দিল্লির সুলতানি আমল: (১২০৪-১৫২৬ খ্রি.)
 

ভূমিকা
ভারতবর্ষে মুসলিম বিজয়ের পূর্বে বৌদ্ধ ও হিন্দু শাসনামলকে ভারতীয় ইতিহাসে ‘প্রাচীন যুগ’ বলা হয়। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ভারতবর্ষে মুসলিম অভিযান ও আরবদের সিন্ধু বিজয় থেকে ভারতে ‘মধ্যযুগের’ সূচনা কাল শুরু এবং মুঘল শাসনের শেষ পর্যন্ত এ যুগের বিস্তৃতি। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে সুলতানি শাসন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১২০৬ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুতুবউদ্দিন, ইলতুৎমিশ, বলবন এবং তাঁদের বংশধরেরা শাসন করেন। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ কুতুবউদ্দিন আইবেককে দাসত্ব থেকে মুক্তির ছাড়পত্র, রাজদণ্ড এবং সুলতান উপাধি প্রদান করেন। প্রথম জীবনে কুতুবউদ্দিন, ইলতুৎমিশ এবং বলবন এই তিনজনই ছিলেন ক্রীতদাস। এক সময় এঁদের সবাইকে একই বংশের লোক বলে মনে করা হতো এবং তাঁদের বংশকে বলা হতো ‘দাস বংশ” । কারণ সিংহাসনে বসার আগে তাঁরা সবাই দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। কিন্তু আসলে এঁরা তিনজনই ছিলেন আলাদা আলাদা বংশের লোক। তাঁদের বংশধরগণ শাসকের সন্তান-সন্ততি হিসেবেই সিংহাসনে বসেন। তাঁরা না ছিলেন একই বংশের, না কেউ সিংহাসনে বসার সময় দাস ছিলেন। সুতরাং তাঁদের বংশকে ‘দাস বংশ’ বলা সমীচীন নয়। তাঁদের শাসনামল ছিল দিল্লি সালতানাতের প্রাথমিক যুগ। আর তাঁরা সবাই ছিলেন জাতিতে তুর্কি। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ তাই তাঁদের শাসনামলকে “প্রাথমিক যুগে দিল্লির তুর্কি সালতানাত” (The Early Turkish Sultanate of Delhi) বলে অভিহিত করেছেন। এই যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দিল্লির তুর্কি সালতানাত সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যুগ ছিল সংহতির যুগ। এই যুগেই দিল্লি সালতানাতের শাসন-কাঠামো গড়ে ওঠে।
ইউনিট সমাপ্তির সময়
ইউনিট সমাপ্তির সর্বোচ্চ সময় ৫ সপ্তাহ
এই ইউনিটের পাঠসমূহ-
পাঠ- ১ : সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক পাঠ- ২ : সুলতান ইলতুৎমিশ
পাঠ- ৩ : সুলতান ইলতুৎমিশের চরিত্র ও কৃতিত্ব পাঠ- ৪ : সুলতান রাজিয়া
পাঠ- ৫ : সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন
পাঠ- ৬ : আলাউদ্দীন খলজী: রাজ্য বিজয়
পাঠ- ৭ : আলাউদ্দিন খলজির শাসন সংস্কার ও কৃতিত্ব
পাঠ- ৮ : তুঘলক বংশ ও মুহাম্মদ বিন তুঘলক
পাঠ- ৯ : ফিরোজ শাহ তুঘলক
পাঠ- ১০ : সৈয়দ বংশ
পাঠ- ১১ : লোদী বংশ
পাঠ- ১২ : সুলতানি আমলে ভারতের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস
পাঠ- ১৩ : দিল্লি সালতানাতের পতনের কারণ ও ফলাফল

 


পাঠ-২.১
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (১২০৬-১২১০ খ্রি.)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক কর্তৃক ‘দাস বংশ’ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জানতে পারবেন ;
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের রাজ্য শাসন প্রণালী সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
আইবেক, সুলতান, দাস বংশ, কুতুব মিনার, চৌগান ও লাখ-বক্স
ভূমিকা
১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় ভারতে পাঁচটি রাজবংশ শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে। এই পাঁচটি রাজবংশের অন্যতম হলো দিল্লির তথাকথিত দাস বংশ (So-called Slave Dynasty)। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১১৯২ খ্রি.) জয়লাভকারী মুইজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মুহাম্মদ ঘোরি নামে সমধিক পরিচিত মুহম্মদ বিন সামের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, তৎকালীন ঘুর রাজ্যের শাসনকর্তা এবং উত্তরাধিকারী গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ তরাইনের যুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি এবং মুহাম্মদ ঘোরির আস্থাভাজন কুতুবউদ্দিন আইবেককে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে সনদ ও ‘সুলতান' উপাধি প্রদান করেন। এভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নেতৃত্বে ভারতে স্বাধীন সুলতানদের শাসনের সূচনা হয়। কুতুবউদ্দিন আইবেক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ইসলামের ইতিহাসে তথাকথিত ‘দাস বংশ” নামে সমধিক পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বংশ ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করে। উল্লিখিত সময়ে (৮৪ বছর) সর্বমোট ১১ জন সুলতান শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এই বংশের প্রথম সুলতান ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক এবং সর্বশেষ সুলতান ছিলেন শামসুদ্দিন কাইমুরস (১২৮৯-১২৯০ খ্রি.)।
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (১২০৬-১২১০ খ্রি.): প্রাথমিক জীবন
দিল্লি সালতানাতের প্রথম সুলতান ভারতীয় উপমহাদেশের তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আইবেক তুর্কিস্থানের বাসিন্দা ছিলেন। তুর্কি ভাষায় ‘আইবেক’ শব্দের অর্থ ‘চন্দ্রদেবতা'। আবার কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কিস্তানের আইবেক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করার কারণে কুতুবউদ্দিনকে ‘আইবেক’ বলা হতো। ঐতিহাসিক বর্ণনানুযায়ী, কুতুবউদ্দিনের জীবন শুরু হয়েছিল ক্রীতদাস হিসেবে। শৈশবে জনৈক ক্রীতদাস ব্যবসায়ী কুতুবউদ্দিনকে পারস্যের নিশাপুরের তৎকালীন কাজি ফখরুদ্দিন আব্দুল আজিজ কুফীর নিকট বিক্রয় করেন। কাজি তাঁর নিজ পুত্রদের সাথে কুতুবউদ্দিনকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। অল্প দিনের মধ্যেই কুতুবউদ্দিন ধর্মশাস্ত্র এবং সামরিক বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। কিন্তু অচিরেই কুতুবউদ্দিনের পুণরায় ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। কাজি ফখরুদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রগণ কুতুবউদ্দিনকে এক দাস ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করে দেয়। এ ব্যবসায়ী তাঁকে অন্য অনেকের সাথে গজনীতে নিয়ে আসেন । গজনীর শাসক মুহাম্মদ ঘোরি কুতুবউদ্দিনকে ক্রয় করেন। বাহ্যিকভাবে অসুন্দর হলেও বিপুল প্রতিভার অধিকারী কুতুবউদ্দিন আইবেক স্বীয় মেধা, মনন, পরিশ্রম এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা বলে অল্প দিনের মধ্যে মালিক মুহাম্মদ ঘোরির অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সুলতান মুহাম্মদ ঘোরি কুতুবউদ্দিনের আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে পুরষ্কার স্বরূপ তাঁকে রাজকীয় অশ্বশালার প্রধান বা ‘আমির-ই-আকুর’ পদে নিয়োগ করেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে কুতুবউদ্দিন আইবেক সুলতান ঘোরির পক্ষে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।
মুহাম্মদ ঘোরির প্রতিনিধি হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবেক
ভারতে কুতুবউদ্দিন আইবেকের শাসনামলকে মোট দুই ভাগে ভাগে করা যায়। প্রথম ভাগ হলো ১১৯২-১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ভাগ ১২০৬-১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রথম ভাগে তিনি মুহাম্মদ ঘোরির প্রতিনিধি হিসেবে এবং দ্বিতীয় ভাগে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শাসন করেন। মুহাম্মদ ঘোরি তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের (১১৯২) পর ভারত ত্যাগ করার প্রাক্কালে বিজিত অঞ্চলে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে
 

 

 


অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেকের ওপর সমর্পণ করেন। কুতুবউদ্দিন ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই হানসী, মীরাট, কোল, দিল্লি ও রণথম্বোর বিজয় সম্পন্ন করে লাহোর থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করেন। কনৌজের রাজা জয়চন্দ্র ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিনের হাতে পরাজিত হয়। কুতুবউদ্দিন গুজরাটের শাসক দ্বিতীয় ভীমদেবকে ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন। ফলে গুজরাট দিল্লি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন কনৌজ, বদাউন এবং চাঁদোয়ার অধিকার করতে সক্ষম হন। তিনি কালিঞ্জর ও মাহোবা ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে জয় করেন। ফলশ্রুতিতে অল্প সময়ের মধ্যে উত্তর ভারতের এক বিশাল অঞ্চলে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বাধীন সুলতান হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবেক
ঘোর বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান এবং ভারত বিজেতা মুহাম্মদ ঘোরি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ঝিলাম জেলার সন্নিকটে এক গুপ্তঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। মুহাম্মদ ঘোরির সুযোগ্য ও বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে কিরমান ও সাদকুয়ানের শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ, উচ ও মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা এবং কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন অন্যতম। মুহাম্মদ ঘোরি মৃত্যুর পূর্বে কুতুবউদ্দিন আইবেককে বিজিত ভারত রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেরে মনোনীত করে তাঁকে ‘মালিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুহাম্মদ ঘোরির ঘুর রাজ্যের উত্তরাধিকারী সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবেককে দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদ প্রদান করেন এবং ‘সুলতান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন লাহোরে কুতুবউদ্দিন আইবেকের অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। লাহোর জামে মসজিদে তাঁর নামে খুৎবা পাঠ করা হয় এবং তাঁর নামেই মুদ্রা প্রচলন করা হয়। মুহাম্মদ ঘোরি কর্তৃক বিজিত ভারতীয় অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সার্বিক নিরাপত্তা বিধান এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কুতুবউদ্দিন আইবেক তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় প্রদান করে ঘোরির অনুচরবর্গের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। প্রথমে তিনি উচ ও মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচার সাথে তাঁর ভগ্নীর বিবাহ দেন। স্বীয় কন্যাকে বিবাহ দেন বদাউনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিশের সাথে। আর নিজেই বিবাহ করেন কিরমানের শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইয়ালদুজের কন্যাকে। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক ক্ষমতা গ্রহণ করে সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দিকে দৃষ্টি দেন। আইবেকের শ্বশুর তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ পারস্য ও মধ্য এশিয়া বিজয়ী খাওয়ারিজম শাহ কর্তৃক গজনী থেকে বিতাড়িত হয়ে ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব দখল করেন। আইবেক তাজউদ্দিনকে প্রথমে পাঞ্জাব থেকে এবং পরে গজনী থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মাত্র ৪০ দিন পর তাজউদ্দিন পুনরায় গজনী দখল করে আইবেককে বিতাড়িত করেন। চান্দেলা রাজপুতগণ কালিঞ্জরে, গহরওয়ালাগণ ফরুখাবাদ ও বদাউনের কিছু অংশে এবং গোয়ালিয়রের প্রতিহারগণ পুনরায় বিদ্রোহী হয়ে উঠলে কুতুবউদ্দিন আইবেক তাদের সেই চেষ্টাকে অতি সহজেই নস্যাৎ করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে বাংলায় আলী মর্দান খলজী কর্তৃক মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নিহত হওয়ার পর খলজী মালিকদের মধ্যে শাসন ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অর্ন্তদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে কুতুবউদ্দিন আলী মর্দানকে লখনৌতি রাজ্য হিসেবে পরিচিত বাংলার শাসন ক্ষমতা প্রদান করেন। মাত্র চার বছর শাসনকার্য পরিচালনার পর ১২১০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে লাহোরে চৌগান বা পোলো খেলার সময় হঠ্যাৎ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং শেষ পর্যন্ত সেই আঘাতেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সমাধি বর্তমানে লাহোরে অবস্থিত।
কুতুবউদ্দিন আইবেকের চরিত্র ও কৃতিত্ব
দিল্লির দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী, স্বাধীনচেতা এবং প্রজাকল্যাণকর শাসক। আইবেক রাজ্যে সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে সচেষ্ট ছিলেন। চারিত্রিক উৎকর্ষতার জন্য তিনি সমসাময়িককালে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন তেজস্বী, প্রতিভাবান এবং উদার চিত্তের অধিকারী। ঐতিহাসিক এ বি এম হবিবুল্লাহ বলেন, “অসাধারণ কর্মশক্তি এবং উঁচুদরের প্রতিভাবান সামরিক নেতা হিসেবে কুতুবউদ্দিন তুর্কিদের অসম সাহসিকতার সাথে পারসিক মার্জিত রুচি ও উদারতার সমন্বয় সাধন করেন।” ঐতিহাসিক হাসান নিজামী কুতুবউদ্দিন আইবেকের উন্নত চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। দানশীলতার দিক থেকে কুতুবউদ্দিনকে হাতেম তাই-এর সাথে তুলনা করা হয়। তিনি প্রত্যেক দিন লক্ষ লক্ষ মুদ্রা দান করতেন বলে কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁকে ‘লাখ বক্স' উপাধি প্ৰদান করেন। তিনি ছিলেন পরমত ও পরধর্ম সহিষ্ণ এবং ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন
 

 


জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। হাসান নিজামী প্রীত হয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটি (তাজুল মাসির) সুলতানের নামে উৎসর্গ করেন । তাঁর রাজদরবারে জ্ঞানী-গুনী ও পন্ডিত ব্যক্তিদের যথেষ্ট সমাদর ছিল। স্থাপত্য শিল্পের উদার পৃষ্ঠপোষক সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লিতে ‘কুয়াত-উল-ইসলাম' এবং আজমীরে ‘আড়াই দিন-কা-ঝোপড়া' মসজিদ নির্মাণ করেন। রাজ্য বিজয়ের স্মারক এবং ইসলামের মহিমা বিশ্বজনীনভাবে উপস্থাপনের অভিপ্রায়ে সুলতান কুতুবউদ্দিন ধর্মবেত্তা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে ‘কুতুব মিনার' নির্মাণ আরম্ভ করেন। তবে তিনি এর নির্মাণ শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁর জামাতা সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের (১২১১-১২৩৬ খ্রি.) শাসনামলে মিনারটির নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হয় ।
শিক্ষার্থীর কাজ
কুতুব মিনার সম্পর্কে একটি টিকা লিখুন।
সারসংক্ষেপ :
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সামান্য একজন দাস হিসেবে জীবনের প্রথম পর্ব শুরু করলেও নিজস্ব মেধা, মনন, বুদ্ধিবৃত্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বশে আনার অভিপ্রায়ে তিনি তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা দূরদর্শিতার পরিচয় প্রদান করেন। কুতুবউদ্দিন আইবেক সাম্রাজ্যের সংহতি বিধান এবং প্রগতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে তিনি একজন আদর্শ শাসকের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ।
 

 


পাঠ-২.২
সুলতান ইলতুৎমিশ (১২১১-১২৩৬ খ্রি:)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
শামসুদ্দিন ইলতুৎমিসের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে জানতে পারবেন ও
শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ কিভাবে দিল্লি সালতানাতের সংহতিসাধন করেন তা বর্ণনা করতে পারবেন ।
মূখ্য শব্দ
জুধ, মোঙ্গল, খাওয়ারিজম, ইকতা, রূপাইয়া, কুতুব মিনার ও বন্দেগান-ই-চেহেলগান
প্রাথমিক জীবন
সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ ছিলেন ইলবারী তুর্কি গোষ্ঠির লোক। তিনি যেমন ছিলেন বুদ্ধিমান, তেমনি ছিলেন দৈহিক সৌন্দর্যের অধিকারী। এজন্য তাঁর ভাইয়েরা তাঁর প্রতি ছিল ঈর্ষাপরায়ণ। তারা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে একজন দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই দাস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বোখারার প্রধান কাজী তাঁকে কিনে নেন। কাজী ইলতুৎমিশের লেখা-পড়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কাজীর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীগণ ইলতুৎমিশকে বিক্রি করে দেয়। ইলতুৎমিশের নতুন মনিব হলেন জালালউদ্দীন নামক এক ব্যক্তি। এই জালালের কাছ থেকে কুতুবউদ্দিন আইবেক ইলতুৎমিশকে উচ্চমূল্যে কিনে নেন। ইলতুৎমিশের গুণে কুতুবউদ্দিন অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি তাঁকে মুক্ত করে বদায়ুনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং নিজ কন্যার সাথে তাঁর বিয়ে দেন। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর আরাম শাহ দিল্লির সুলতান হন। কুতুবউদ্দিনের সাথে আরাম শাহের সম্পর্ক নিয়ে মতভেদ আছে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, আরাম শাহ ছিলেন কুতুবউদ্দিনের পুত্র। কিন্তু মিনহাজ-উস-সিরাজ বলেন, কুতুবউদ্দিনের কোন পুত্র সন্তান ছিলনা। তাঁর শুধু তিন জন কন্যা ছিলেন বলে মিনহাজ উল্লেখ করেছেন। আবুল ফজলের মতে, আরাম শাহ ছিলেন কুতুবউদ্দিনের ভাই ।
সিংহাসনারোহণ
আরাম শাহ শাসক হিসেবে একেবারেই অযোগ্য প্রমাণিত হন। দিল্লির আমিরগণ তাই কুতুবউদ্দিনের জামাতা ও বদায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিশকে সুলতান পদ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান করেন। ইলতুৎমিশ এতে রাজী হন। দিল্লির অদূরে আরাম শাহের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ১২১১ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজকীয় উপাধি হয় সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ। তিনি সিংহাসনে বসার পর গজনীর শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ ও সিন্ধুর শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা তাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। বাংলার শাসনকর্তা আলী মর্দান খলজীও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । আমিরদের মধ্যেও রেষারেষী ছিল। তাঁরা ছিলেন তিনভাগে বিভক্ত। মুহম্মদ ঘোরির আমলের আমিরগণ “মুইজ্জী আমির”, কুতুবউদ্দিনের আমলের আমিরগণ “কুতুবী আমির” এবং ইলতুৎমিশের আমলের আমিরগণ “শামসী আমির” নামে অভিহিত হতেন। কুতুবী আমিরগণ ইলতুৎমিশকে সমকক্ষ এবং মুইজ্জী আমিরগণ তাঁকে তাঁদের চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন বলে গণ্য করতেন । ইলতুৎমিশ বিদ্রোহী আমিরদের জুধের যুদ্ধে পরাজিত করে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দেন এবং নিজের অবস্থান মজবুত করেন। ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইয়ালদুজকে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত করেন। তিনি কুবাচাকেও পরাজিত করেন। ঠিক এই সময় আর একটা ভয়াবহ বিপদ উপস্থিত হয়। মধ্য এশিয়া দিক থেকে। দিগ্বিজয়ী বীর চেঙ্গিস খান সমগ্র মধ্য এশিয়া এ সময় পদানত করেন। খাওয়ারিজমের শাহ তাঁর নিকট পরাজিত হন। শাহের পুত্র জালাল উদ্দিন ইলতুৎমিশের কাছে আশ্রয় চান। ইলতুৎমিশ তখন পড়েন উভয় সঙ্কটে। আশ্রয় প্রার্থীকে আশ্রয় না দিলে রীতি রক্ষা হয় না। অপরদিকে আশ্রয় দিলে চেঙ্গিসের কোপানলে পড়তে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি বুদ্ধিমত্তার আশ্রয় নিলেন। তিনি জালালকে বলে পাঠালেন যে ভারতের আবহাওয়া তাঁর জন্য তেমন সুখকর হবে না, সুতরাং তিনি যেন অন্যত্র আশ্রয় খুঁজে নেন। বাধ্য হয়ে জালালকে ভারত ত্যাগ করতে হয়। তবে যাওয়ার আগে তিনি লাহোর, মুলতান ইত্যাদি অঞ্চল লুট করে যান। এতে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্থ হন ইলতুৎমিশের শত্রু কুবাচা। জালালের পর পরই চেঙ্গিস ভারতের সিন্ধুতে এসে উপনীত হন। ইলতুৎমিশ তাঁকে অনেক উপঢৌকন দিয়ে বিদায় করেন। এভাবে ইলতুৎমিশের চতুর বুদ্ধিমত্তায় সমূহ বিপদ থেকে ভারত রক্ষা পেল। ইলতুৎমিশ অত:পর বাংলার দিকে নজর দেন। বাংলায় তখন গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজীর শাসন
 

 

 


চলছিল । আলী মর্দানকে পরাজিত ও নিহত করে হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খলজী ১২১১ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। তিনি “সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজী” উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি সুশাসক ছিলেন। তাঁর নামে মুদ্রা প্রচলিত ছিল এবং ‘খুতবায়’ তাঁর নাম উচ্চারিত হতো। এ সবই রাজকীয় ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ নিজেই ইওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। ইওয়াজ বশ্যতা স্বীকার করে রেহাই পান। ইলতুৎমিশ তাঁকে স্বপদে বহাল রাখেন। কিন্তু সুলতান রাজধানীতে ফিরে আসা মাত্র ইওয়াজ খলজী দিল্লির কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। তাঁকে দমন করার জন্য ইলতুৎমিশ তাঁর বড় ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে প্রেরণ করেন। ইওয়াজ যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন (১২২৭ খ্রি.)। বাংলার উপর দিল্লির কর্তৃত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে সাম্রাজ্যের পশ্চিম এলাকাও ইলতুৎমিশের নিয়ন্ত্রণে আসে। ইয়ালদুজের মৃত্যুর পর লাহোরের উপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাকী ছিল সিন্ধু ও মুলতান। ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে বাক্কারের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। সিন্ধু নদ পার হতে গিয়ে কুবাচা মারা যান। ফলে সিন্ধু ও মুলতানের উপরও তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ বাগ্দাদের আব্বাসীয় খলিফা আল- মুনতাসিরের কাছ থেকে “সুলতান-উল-আজম” খেতাব সহ রাজছত্র ও রাজকীয় পোশাক উপঢৌকন হিসেবে লাভ করেন। এতে তাঁর গৌরব অনেক বেড়ে যায়। নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীদের একে একে দমন করার পর ইলতুৎমিশ হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহ দমনে মনোযোগ দেন। তিনি রণথম্ভোর পুনর্দখল করেন। গোয়ালিয়রও তাঁর দখলে আসে। মালবের ভিলসা এবং উজ্জয়িনীও তিনি জয় করেন। ইলতুৎমিশ অত্যন্ত দক্ষ শাসক ছিলেন। যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যেও তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি জ্ঞানী-গুণীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতে প্রাথমিক তুর্কি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। পঁচিশ বছর অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শাসন করার পর ১২৩৬ খ্রি. তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ।
ইলতুৎমিশের মুদ্রা
শিক্ষার্থীর কাজ
ইলতুৎমিশের “সুলতান-উল-আজম” খেতাব প্রাপ্তি ব্যাখ্যা করুন ।
সারসংক্ষেপ :
ইলতুৎমিশ দাস হিসেবে জীবন শুরু করেন। নানা প্রভুর হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত তিনি কুতুবউদ্দিনের অধীনে আসেন। | কুতুবউদ্দিন তাঁর গুণে মুগ্ধ হন। তাঁকে মুক্তি দিয়ে সুলতান তাঁর সাথে নিজ কন্যার বিয়ে দেন এবং তাঁকে বদায়ুনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর আরাম শাহ সুলতান হন। আমিরদের অনুরোধে অযোগ্য আরাম শাহকে পরাজিত করে ইলতুৎমিশ সিংহাসনে বসেন। তিনি নব গঠিত দিল্লি সালতানাতকে নানা বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তিনি ইয়ালদুজ, কুবাচা ও ইওয়াজের বিরোধিতা নির্মূল করেন। এর ফলে লাহোর, সিন্ধু-মুলতান এবং বাংলার উপর দিল্লির কর্তৃত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি কৌশলে চেঙ্গিস খানের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকেও ভারতকে রক্ষা করেন। বিদ্রোহী হিন্দু রাজাদের দমন করে তিনি দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁকে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
 

 

 


পাঠ-২.৩
সুলতান ইলতুৎমিশের চরিত্র ও কৃতিত্ব (১২১১-১২৩৬ খ্রি:)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং
দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুলতান ইলতুৎমিশের কৃতিত্ব সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
‘ইকতা’, জালোর, গোয়ালিয়র, উজ্জয়িনী ও বদাউন
সুলতান ইলতুৎমিশের চরিত্র
শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ আরাম শাহকে পরাজিত করে ত্রয়োদশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকে দিল্লি সালতানাতের মামলুক বা দাস (তুর্কি) বংশের তৃতীয় শাসক হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুলতানের দায়িত্ব পালন করেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা এবং দৃঢ় চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। সমসাময়িককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আউলিয়া বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, শেখ জালাল উদ্দিন তাব্রিজী এবং খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। দানশীলতার কারণে দাস (তুর্কি) বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক ‘লাখ বক্‌শ' উপাধি প্রাপ্ত হন। কিন্তু যুগের মাপকাঠিতে দেখা যায় সুলতান ইলতুৎমিশ আইবেকের চেয়েও অধিকতর দানশীল ছিলেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ উস-সিরাজ, সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের প্রশংসায় বলেন- “ইলতুৎমিশের ন্যায় এত ধার্মিক, দয়ালু, বিদ্যানুরাগী, ও দরবেশগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সুলতান দিল্লির সিংহাসনে আর কখনও আরোহণ করেননি।” সমসাময়িক কালের ঐতিহাসিকগণ সুলতান ইলতুৎমিশকে “আল্লাহর বান্দাগণের সাহায্যকারী” এবং “আল্লাহর রাজ্যের রক্ষক” প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করেছেন ।
সুলতান ইলতুৎমিশের কৃতিত্ব
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর দুর্বল ও অকর্মণ্য আরাম শাহ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। আরাম শাহের দুর্বল শাসন ব্যবস্থা ও অযোগ্যতার কারণে রাজ্যের মধ্যে ব্যাপক বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আরাম শাহের শাসন ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট দিল্লির অভিজাত আমির উমরাহদের আমন্ত্রণে কুতুবউদ্দিন আইবেকের জামাতা এবং বদাউনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিশ দিল্লির উপকণ্ঠে জুধ নামক স্থানে এক বিশাল বাহিনী সহকারে আরাম শাহকে পরাজিত ও নিহত করে দিল্লির সিংহাসনে উপবেশন করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ মুঈজ্জী ও কুতুবী আমিরগণের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। তিনি তাদেরকে পরাজিত করে দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী অযোধ্যা, বেনারস, বদাউন, সিউয়ালিক প্রভৃতি অঞ্চলের উপর স্বীয় আধিপত্য সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। গজনীর শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইয়ালদুজ পাঞ্জাব থেকে থানেশ্বর পর্যন্ত দখল করে সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সুলতান ইলতুৎমিশ ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমন করেন।
উচ ও মুলতানের শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচা লাহোর দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশ তাঁকে পরাজিত করে লাহোর দখল করেন। ১২১১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসনকর্ম গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি সুলতান' উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশের বশ্যতা স্বীকার করলেও গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যুবরাজ নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বিদ্রোহী গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে পিতা সুলতান ইলতুৎমিশ কর্তৃক বাংলার শাসক নিযুক্ত হন। ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ বাংলা দিল্লির কেন্দ্রিয় সরকারের আওতাধীন হয়ে পড়ে। সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে রণথম্ভোর মান্দাওয়ার, জালোর, গোয়ালিয়র, উজ্জয়িনী, বদাউন, বেনারস, কনৌজ, দোয়াব ও অযোধ্যা দিল্লি সালতানাতের অধিভুক্ত করে উপমহাদেশে একটি সুদৃঢ় এবং প্রজাকল্যাণকর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান কর্তৃক বিতাড়িত খাওয়ারিজমের শাহ 
 

 

 


ইলতুৎমিশের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেও তিনি কৌশলে আশ্রয়দানে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। মধ্যযুগীয় একজন সুলতানি শাসকের এই কূটনৈতিক মেধার কারণেই এ সময় ভারতীয় উপমহাদেশ মোঙ্গল আক্রমণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
রাজ্যে বিদ্রোহ দমন এবং শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের পর সুলতান ইলতুৎমিশ সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার প্রতি মনোনিবেশ করেন। ভারতবর্ষে প্রকৃত তুর্কি শাসন ব্যবস্থার গোড়াপত্তনকারী সুলতান ইলতুৎমিশ। বলা হয় সুলতান ইলতুৎমিশ যে শাসন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন তার উপর ভিত্তি করে খলজিদের আমলে এক সামরিক সাম্রাজ্যবাদের সৌধ গড়ে উঠে। সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে সুলতান ইলতুৎমিশ দিল্লিতে সামরিক ও বেসামরিক বিভিন্ন দপ্তর স্থাপন করেন। রাজস্বব্যবস্থা ও অর্থ পরিদপ্তর পুনর্গঠনের জন্য তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমগ্র রাজ্যকে কতগুলো ‘ইকতা’ বা প্রদেশে বিভক্ত করে ইকতাদারদেরকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন ন্যায়বিচারের মূর্ত প্রতীক। প্রজাসাধারণ যাতে সহজে ন্যায় বিচারের জন্য সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এই লক্ষ্যে তিনি রাজদরবারে একটি শিকল বাঁধা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। সুলতান ইলতুৎমিশ এক ধরনের রৌপ্য মুদ্ৰা প্রবর্তন করেন যা ‘তংকা' নামে পরিচিত। সুলতান ইলতুৎমিশ জ্ঞানী-গুণী, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পণ্ডিত ব্যক্তি, কবি এবং ধার্মিক ব্যক্তিদের পৃষ্ঠাপোষকতা প্রদান করতেন। কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে কুতুব মিনার নির্মাণ শুরু করলেও তা সমাপ্ত করেন সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ। এছাড়াও তিনি শ্বশুর কুতুবউদ্দিন আইবেক কর্তৃক নির্মিত দিল্লির ‘কুয়াত উল-ইসলাম মসজিদ' এবং আজমীরের ‘আড়াইদিন-কা-ঝোপড়া' মসজিদ এর সংস্কার সাধন করেন। ইলতুৎমিশ ভারতীয় উপমহাদেশে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। তিনি ৪০ জন তুর্কি ক্রীতদাসের সমন্বয়ে ‘বন্দেগান-ই- চেহেলগান' নামক চল্লিশ চক্রের শাসকগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক দাস বংশের প্রতিষ্ঠা করলেও নানা বিদ্রোহ ও প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করে একে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান শাসমুদ্দিন ইলতুৎমিশ । তাই ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ যথার্থই বলেছেন যে, ইলতুৎমিশ ছিলেন নিঃসন্দেহে দাস বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
 

 


পাঠ-২.৪
সুলতান রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রি:)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
সুলতান রাজিয়ার সিংহাসন লাভের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে পারবেন; সুলতান রাজিয়া কর্তৃক বিদ্রোহ দমন সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন এবং
সুলতান রাজিয়ার চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
তাজিক আফগান, আমির-ই-আখুর, কারামিতা, আমির-ই-হাজিব ও কাইথল
সুলতান রাজিয়ার সিংহাসন লাভের প্রেক্ষাপট
১২২৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিদ্রোহী শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজির বিদ্রোহ দমন করে সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন। দূরদর্শী সুলতান ইলতুৎমিশ তাঁর সুযোগ্য কন্যা, বুদ্ধিমতী ও অনন্য প্রতিভার অধিকারী রাজিয়াকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তাঁর মনোনয়ন অস্বীকার করে কতিপয় অভিজাত সুলতান পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে আরোহণে সহায়তা প্রদান করেন। কিন্তু রুকনউদ্দিন ফিরোজ ছিলেন অদক্ষ। রুকনউদ্দিনের দুঃশাসনে সাম্রাজ্যের চতুর্দিকে চরম অরাজক পরিস্থিতি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় রানীমাতা শাহ তুরকান শাসন ক্ষমতা হস্তগত করেন। তথাপিও রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষাপটে দিল্লির অভিজাত শ্রেণি, আমির উমারাহগণ রুকনউদ্দিন ফিরোজ এবং রানীমাতা শাহ তুরকানকে দিল্লির উপকণ্ঠে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করে কারাগারে বন্দি করেন। এই ঘটনার পর আমির উমারাহগণ রাজিয়াকে দিল্লির সিংহাসনে আমন্ত্রণ জানান ।
বিদ্ৰোহ দমন :
সিংহাসনে আরোহণ করে সুলতান রাজিয়া একটি সুশৃঙ্খল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে আত্মনিয়োগ করেন। সুদূর বাংলা প্রদেশ এবং উচের শাসকগণও সুলতান রাজিয়ার আনুগত্য স্বীকার করেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ বলেন, “লক্ষ্মণাবতী হতে দেবল এবং ডামরিলা পর্যন্ত দেশের সকল মালিক ও আমিরগণ তাঁর আনুগত্য ও প্রভুত্ব স্বীকার করে নেন।” রাজিয়ার পূর্ববর্তী শাসকদের সময় প্রশাসনের সকল পদে তুর্কি আমির-উমারাহদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু প্রশাসন থেকে ক্রমান্বয়ে তুর্কি প্রভাব হ্রাস করার অভিপ্রায়ে সুলতান রাজিয়া তাজিক আফগানদের অন্তর্ভুক্ত হাবসী অনুচর জামালউদ্দিন ইয়াকুতকে ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আমির-ই-আখুর' পদে নিয়োগ প্রদান করেন। তুর্কি আমিরগণ এই নিয়োগে অসন্তুষ্ট হয়ে সুলতান রাজিয়ার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী জুনাইদিও তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। কারামিতা ও মুলাহিদ সম্প্রদায় নূরউদ্দিন নামক জনৈক তুর্কির নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সুলতান রাজিয়া এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেন। আমির-ই-হাজিব আইতিগিনের নেতৃত্বে তুর্কি আমিরগণও ক্রমাগত বিরোধিতা করতে থাকে। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে রাজিয়া পাঞ্জাবের বিদ্রোহী শাসনকর্তা কবির খানকে দমন করেন। ভাতিন্দার শাসনকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন আলতুনিয়া সুলতান রাজিয়ার বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহের সূত্রপাত করেন। সুলতান রাজিয়া এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আলতুনিয়ায় বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। উভয়পক্ষের মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে জামাল উদ্দিন ইয়াকুত নিহত হন এবং সুলতান রাজিয়া আলতুনিয়ার হাতে বন্দী হন। অন্যদিকে সুলতান রাজিয়ার বন্দিত্ব ও অনুপস্থিতির সুযোগে দিল্লির আভিজাত আমিরগণ সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের তৃতীয় পুত্র মুইজউদ্দিন বাহরামকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। সুলতান রাজিয়া কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আলতুনিয়াকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং বন্দিদশা থেকে সহজে মুক্তি লাভ করেন। এরপর সিংহাসন পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে আলতুনিয়া ও রাজিয়া উভয়ে বাহরামের বিরুদ্ধে এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু দিল্লির সন্নিকটে মুইজউদ্দিন বাহরামের বাহিনীর হাতে এই সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কাইথল নামক স্থানে জনৈক হিন্দু আততায়ীর হাতে সুলতান রাজিয়া ও তাঁর স্বামী ইখতিয়ারউদ্দিন আলতুনিয়া নিহত হন।
 

 


সুলতান রাজিয়ার চরিত্র ও কৃতিত্ব:
সুলতান রাজিয়া ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, বুদ্ধিমতী এবং সুদক্ষ যোদ্ধা। তিনি ছিলেন দিল্লি সালতানাতে আরোহণকারী প্রথম এবং একমাত্র নারী শাসক। তিনি সুলতানের পোশাক পরিধান করে প্রকাশ্য রাজদরবারে আবির্ভূত হতেন। যুদ্ধের মাঠে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। যুদ্ধবিদ্যা ও অশ্বারোহণেও সুলতান রাজিয়া ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সাময়িকভাবে হলেও তিনি দিল্লির আমির-উমারাহদের উপর স্বীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সুলতান রাজিয়া নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন এবং মুদ্রায় নিজেকে ‘উমদাদ-উল-নিসওয়ান' বলে অভিহিত করেন। সুলতান রাজিয়া ছিলেন সাহিত্যিক, পণ্ডিত ও বিদ্যান ব্যক্তির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। ঐতিহাসিক আবুল কাশিম ফিরিস্তার বর্ণনানুযায়ী সুলতান রাজিয়া বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও চমৎকার ভঙ্গিসহকারে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতে পারতেন। ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস্-সিরাজ বলেন, তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সুলতান-বুদ্ধিমতী, ন্যায়বর্তী মহানুভব, বিদ্যোৎসাহী, সুবিচারক, প্রজাগণের রক্ষাকারী সামরিক প্রতিভাসম্পন্ন এবং রাজাদের প্রয়োজনীয় সকল প্রকার গুণাবলি ও যোগ্যতার অধিকারী। তাঁর চরিত্রে বিভিন্ন গুণাবলির অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। প্রশাসনে তুর্কিদের প্রাধান্য ক্ষুন্ন করার মানসে সুলতান রাজিয়া বিভিন্ন উচ্চ পদে তাজিক আফগানদের নিয়োগ করেন। তিনি কারামিতা ও মুলাহিদ সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেন। পাঞ্জাবের শাসকনকর্তা কবির খানকেও সুলতান রাজিয়া দমন করতে সক্ষম হন।
* সুলতান রাজিয়ার চরিত্রে বিভিন্ন গুণাবলির অপূর্ব সমাবেশ সম্পর্কে লিখুন ।
শিক্ষার্থীর কাজ
সারসংক্ষেপ :
দিল্লি সালতানাতের ইতিহাসে যে সকল শাসক সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে এবং পরে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন সুলতান রাজিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। পিতা ইলতুৎমিশ কর্তৃক সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও প্রভাবশালী আমির উমারাহদের দৌরাত্ম্যের কারণে তিনি সিংহাসনে উপবেশনে করতে পারেননি। পরবর্তীতে সিংহাসনে আরোহণের পর সুলতান রাজিয়া বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করে রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু তিনি ভাতিন্দার শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন আলতুনিয়ার নিকট পরাজিত ও বন্দি হন। পরবর্তীতে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুঈজ উদ্দিন বাহরামের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। শেষ পর্যন্ত রাজিয়া এবং তাঁর স্বামী আলতুনিয়া আততায়ীর হাতে নিহত হন।
 

 

 

 


পাঠ-২.৫
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
বিদ্রোহ দমনে বলবন কর্তৃক গৃহীত নীতি সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন;
বলবন কর্তৃক মেওয়াটি দস্যুদের দমন ও বাংলার বিদ্রোহ প্রশমন সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন ও
বলবনের মোঙ্গলনীতি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
ইলবারি, বলবন, মোঙ্গল, খাসবরদার, আমির-ই-শিকার, আমির-ই-হাজীব ও উলুঘ খান
বলবনের প্রাথমিক জীবন
গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিশের (১২১১-১২৩৬ খ্রি.) কনিষ্ঠ পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি.) শ্বশুর। গিয়াসউদ্দিন বলবন তুর্কিস্তানের বিখ্যাত ইলবারি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। বলবনের প্রকৃত নাম ছিল বাহাউদ্দিন। বলবন এবং উলুঘ খান এ দু'টো ছিল তাঁর উপাধি। বলবনের রাজ উপাধি ছিল গিয়াসউদ্দিন। শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের ন্যায় গিয়াসউদ্দিন বলবন যৌবনেই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হন। বাগদাদের খাজা জামালউদ্দিন বসরী নামক জনৈক ব্যক্তির নিকট মোঙ্গলরা গিয়াসউদ্দিন বলবনকে বিক্রি করে দেন। খাজা জামাল উদ্দিন নিজেও ছিলেন একজন দাস ব্যবসায়ী। ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অন্যান্য দাসদের সাথে গিয়াসউদ্দিন বলবনকেও দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং দিল্লির তৎকালীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের নিকট বিক্রি করে দেন। প্রখর মেধা এবং ধীশক্তি সম্পন্ন গিয়াসউদ্দিন বলবন অচিরেই তাঁর নানামুখী প্রতিভাবলে সুলতান ইলতুৎমিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সুলতান ইলতুৎমিশ গিয়াসউদ্দিন বলবনকে তাঁর ইতিহাস প্রসিদ্ধ বিখ্যাত ‘বন্দেগান-ই-চেহেলগান' বা ‘চল্লিশ চক্রের’ অন্তর্ভুক্ত করেন। বলবন ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিশের ‘খাসবরদার’ বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তা।
সুলতান রাজিয়ার (১২৩৬-১২৪০খ্রি.) শাসনামলে বলবন ছিলেন আমির-ই-শিকার। সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র মুইজউদ্দিন বাহরামের সময় বলবন যথাক্রমে রেওরী এবং হাসীর ভূস্বামীর দায়িত্ব পালন করেন। মুইজউদ্দিন বাহরামের সময় তিনি ‘আমির-ই-হাযীব’ (রাজগৃহাধ্যক্ষ) পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন মাসুদের (১২৪২-১২৪৬) শাসনামলেও বলবন ‘আমির-ই-হাযিব’ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রভাব প্রতিপত্তি মূলত: বৃদ্ধি পায় সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি.) শাসনামলে সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের সময় পাঞ্জাবে মেসু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা উপদ্রব শুরু করলে গিয়াসউদ্দিন বলবন কঠোর হস্তে এবং অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই বিদ্রোহ দমন করেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ গিয়াসউদ্দিন বলবনকে ‘উলুঘ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবন ‘নায়েব-ই-মামলিকাত' পদে নিযুক্ত হন এবং সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ প্রদান করেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদের দুর্বলতার সুযোগে শ্বশুর গিয়াসউদ্দিন বলবন প্রকৃত সুলতানের ক্ষমতা চর্চা করতেন এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান করেন। বলবনের জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পরিলক্ষিত হয়। যেমন: ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইমাম উদ্দিন রায়হান নামক জনৈক প্রভাবশালী আমিরের নেতৃত্বে তুর্কি আমিরদের ষড়যন্ত্রের কারণে বলবন ক্ষমতাচ্যুত হলেও ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় পূর্বপদে অধিষ্ঠিত হয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। গিয়াসউদ্দিন বলবন ১২৪৯ ও ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে মুলতান ও অযোধ্যার বিদ্রোহ দমন করে শান্তি স্থাপন করেন। তিনি দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের আক্রমণ হতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং বাংলা ও বিহারের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। কালিঞ্জর ও গোয়ালিয়রের হিন্দু নরপতি এবং মেওয়াটের উপজাতিদের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে বলবন দোয়াবে শান্তি স্থাপন করেন। এভাবে গিয়াসউদ্দিন বলবন সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের শাসনামলে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত শাসন-ক্ষমতা ভোগ করেন ।
বলবনের সিংহাসনে আরোহণ
সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি.) কোনো সন্তান ছিল না। তিনি ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিশের সর্বশেষ সন্তান। ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তাঁর শ্বশুর গিয়াসউদ্দিন বলবনকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি বলবন ৬০ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণে
 

 

 


করেন। তিনি সালতানাতের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বলতেন, রাজা হচ্ছেন আল্লাহর প্রতিনিধি। তিনি রাজার দৈবসত্ত্বায় বিশ্বাস করতেন। বলবন ‘জিল্লুল্লাহ' উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি সালতানাতের প্রতি জন সাধারণের শ্রদ্ধা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজদরবারে পারসিক রীতির প্রবর্তন করেন।
বিদ্রোহ দমনে কঠোর নীতি অবলম্বন
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন সাম্রাজ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাবাদ, গোলযোগ ও বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা নির্মূল করার উদ্দেশ্যে এক অভিনব ও নির্মম নীতি অবলম্বন করেন। সুলতান কর্তৃক গৃহীত এই নীতি ইতিহাসে ‘রক্তপাত ও কঠোরতার নীতি' (Blood and Iron Policy) নামে পরিচিত। সুলতান ইলতুৎমিশ তাঁর বিশ্বস্ত ও সুযোগ্য চল্লিশজন ক্রীতদাসকে নিয়ে বিখ্যাত ‘বন্দেগান-ই-চেহেলগান' বা চল্লিশ চক্র গঠন করেছিলেন। বলবন নিজেও ছিলেন এই দলের একজন সদস্য। কিন্তু তিনি সুলতান হওয়ার পর এই চক্র তাঁর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সুলতান বলবন এই চল্লিশ চক্রের প্রভাব হ্রাস করার জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যেমন, প্রথমত: তাদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা বাতিল করা, দ্বিতীয়ত: তাদের বল্গাহীন স্বাধীনতা রহিত করা, তৃতীয়ত: তাদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা, চতুর্থত: রাজদরবারে তাদের হাসি-ঠাট্টা নিষিদ্ধ করা এবং পঞ্চমত: তাদের প্রদেয় জায়গীরদারি বাতিল করা। এমনকি সামান্য অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধানও প্রয়োগ করেন। আমির খান, হায়বৎখান এবং বরবকসহ বহু প্রভাবশালী অভিজাতকে তিনি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন । তিনি আপন চাচাতো ভাই ও চল্লিশ চক্রের অন্যতম সদস্য শেরখানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন স্বেচ্ছাচারী এবং আধিপত্যবাদী স্বৈরশাসক। তার স্বৈরশাসন নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগের জন্য সাম্রাজ্যের সর্বত্র গুপ্তচর নিয়োগ করেন। অত্যন্ত চৌকস, অনুগত এবং বিশ্বস্ত এসব গুপ্তচরেরা সমস্ত গোপন সংবাদ সুলতানকে সরবরাহ করত এবং শাসন ব্যবস্থা নির্বিঘ্নে পরিচালনায় সহযোগিতা প্রদান করত। অভ্যন্তরীণ এবং বহি:স্থ গোলযোগ ও বিদ্রোহ দমন করার জন্য সুলতান বলবন সামরিক বাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে গড়ে তুলেন।
মেওয়াটি দস্যুদের দমন
দুধর্ষ মেওয়াটি দস্যুরা ছিল মেওয়াট বা আলোয়ারের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী। এই রাজপুত মেওয়াটি দস্যুগণ প্রকাশ্যে দিল্লির রাজপথে পথিকদের সবকিছু লুঠ করে নিয়ে যেত। সুলতান বলবন দিল্লির উপকণ্ঠ থেকে এসকল দস্যুদের বিতাড়িত করেন এবং তাদের অনেককে হত্যা করেন। সুলতান নিজেই মেওয়াটি দস্যুদের প্রধান ঘাঁটি কাম্পিল, পাতিয়ালী, ভোজপুর প্রভৃতি স্থানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মেওয়াটি দস্যুদের ভবিষ্যত আক্রমণ থেকে দিল্লিকে রক্ষার জন্য সুলতান বলবন গোপালগীরের দুর্গ নির্মাণ করেন এবং জালালী দুর্গটি সংস্কার করেন।
বাংলার বিদ্রোহ দমন
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন যখন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত সেই সুযোগে বিদ্রোহ প্রবণ বাংলার শাসক তুঘরিল খান ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির শাসন অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তুঘরিল ‘সুলতান মুঘিস উদ্দিন' উপাধি ধারণ করে সার্বভৌমত্বের প্রতীক স্বরূপ খুতবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন।
বলবনের মোঙ্গল নীতি
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে (১২৬৬-১২৮৭খ্রি.) ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ শুরু হয় । মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। তিনি সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে পুনর্গঠিত করেন। সামরিক ঝুঁকিপ্রবণ এলাকাগুলোতে নতুন নতুন দুর্গনির্মাণ এবং পুরাতন দুর্গগুলোর সংস্কার সাধন করেন। সুলতান বলবন সামানা, মুলতান এবং দিপালপুরকে একত্রিত করে সীমান্তবর্তী প্রদেশ গঠন করেন এবং সুযোগ্য শাসনকর্তাদের উপর সেগুলোর শাসনভার অর্পণ করেন। সুলতান বলবন সর্বদা রাজধানীতেই অবস্থান করার উদ্দেশ্যে দূরবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন।
সুলতান বলবন অযোধ্যার শাসক আমিন খান, সেনানায়ক মালিক তারঘি ও শাহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে উপর্যুপরি তিনবার বাংলায় অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাধ্য হয়ে সুলতান বলবন স্বয়ং তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা অভিযানে অগ্রসর হন। বাংলার বিদ্রোহী শাসক তুঘরিল খান বলবনের বিশাল বাহিনীর আগমনের সংবাদে রাজধানী লক্ষণাবতী থেকে পলায়ন করে সোনারগাঁও এ আশ্রয় গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত তুঘরিল খান বলবনের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন (১২৮১ খ্রি.)। বলবন বুঘরা খানকে প্রয়োজনীয় উপদেশ প্রদান করে বাংলার শাসক নিয়োগ করেন ।
 

 

 


মুলতান ও দিপালপুরের প্রথম শাসনকর্তা ছিলেন শের খান। তার মৃত্যুর পর বলবন তাঁর প্রথম পুত্র মুহম্মদকে মুলতান ও দিপালপুরের এবং দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানকে সামানা ও সুসানের শাসক নিযুক্ত করেন। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলগণ শতদ্রু নদী পার হয়ে নৃশংসতা আরম্ভ করলে যুবরাজ মুহম্মদ ও বুঘরা খান এবং মালিক মোবারকের যৌথ আক্রমণে মোঙ্গলদের পরাজয় ঘটে। তবে সেনাপতি তামারের নেতৃত্বে মোঙ্গলগণ ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব আক্রমণ করলে যুবরাজ মুহাম্মদ তাদের সাথে সংঘঠিত এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত হন। শেষ পর্যন্ত বলবনের সৈন্যবাহিনী মোঙ্গলদের বিতাড়িত করে লাহোর পুন:দখল করেন। ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে বলবন বাংলার শাসক দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে চাইলেও তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করায় বলবন যুবরাজ মুহম্মদের পুত্র কায়খসরুকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
শিক্ষার্থীর কাজ
বলবনের মোঙ্গল নীতি ব্যাখ্যা করুন।
সারসংক্ষেপ :
গিয়াসউদ্দিন বলবন সামান্য একজন ক্রীতদাস হিসেবে সুলতান ইলতুৎমিশের দরবারে প্রাথমিক জীবন শুরু করলেও সময়ের ধারাবাহিকতায় তাঁর নিজস্ব মেধা, মনন ও অনন্য প্রতিভাগুণে সুলতান ইলতুৎমিশের আস্থা অর্জন করেন। ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে নি:সন্তান অবস্থায় সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে গিয়াসউদ্দিন বলবন সুলতান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে বলবন চল্লিশ চক্রের প্রভাব ক্ষুণ্ন করেন, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন, দুর্ধর্ষ মেওয়াটি দস্যুদের দমন করেন এবং বাংলার বিদ্রোহী শাসক তুঘরিল খানের বিদ্রোহ দমন করেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বারংবার মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে সুলতান বলবন সচেষ্ট ছিলেন। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন রাজ্য বিজয় অপেক্ষা বিজিত রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন এবং সাম্রাজ্যের সংহতি বিধানে বিশ্বাসী ছিলেন। মহান শাসক ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ।

 

 

 


পাঠ-২.৬
আলাউদ্দিন খলজি: রাজ্য বিজয়
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
আলাউদ্দিন খলজির সিংহাসনে আরোহণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে পারবেন;
আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত বিজয় সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন ও
আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ আমীরে তুজুক, দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, জওহব্রুত, খিজিরাবাদ, রায়-রায়ান ও দেবগিরি
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির সিংহাসনারোহণের প্রেক্ষাপট সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন মুসলিম ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ও সফল শাসক। তিনি ছিলেন খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজির ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা। তাঁর বাবার নাম ছিল শাহাবউদ্দিন । পিতৃ বিয়োগের পর আলাউদ্দিন খলজি পিতৃব্য জালাল উদ্দিন ফিরোজের স্নেহে লালিত পালিত হন এবং যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। পিতৃব্য জালালউদ্দিন সিংহাসনারোহণ করে আলাউদ্দিনকে ‘আমীরে তুজুক' পদে অধিষ্ঠিত করেন। আলাউদ্দিন খলজি কারা প্রদেশ এবং অযোধ্যায় শাসকের পদও অলংকৃত করেন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেবগিরিতে অভিযান পরিচালনা করে প্রচুর ধন-রত্ন হস্তগত করেন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই আলাউদ্দিন খলজি নিজ পিতৃব্য ও শ্বশুর জালালউদ্দিন ফিরোজকে হত্যা করে নিজেকে দিল্লির সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন ।
বিজেতা হিসেবে আলাউদ্দিন খলজি
গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ন্যায় সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন একজন সাম্রাজ্যবাদী সমরনায়ক। তিনি নিজে মুদ্রায় দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উপাধিও গ্রহণ করেছিলেন। ডব্লিউ হেগ-এর মতে, “আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল হতেই দিল্লি সালতানাতের যুগ শুরু হয় এবং অর্ধ শতাব্দির বেশীকাল তা বলবৎ ছিল।” সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৭ খ্রি. থেকে ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর ভারতের গুজরাট রণথম্ভোর, মেবার, মালব, উজ্জয়িনী, ধর, চান্দেরীসহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে তাঁর আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। অন্যদিকে, ১৩১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রামেশ্বর সেতু পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের এক বিশাল অঞ্চলের উপর নিজ কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
উত্তর ভারতে রাজ্য বিস্তার:
গুজরাট অভিযান ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি নিজ ভ্রাতা উলুঘ খান এবং মন্ত্রী নুসরাত খানকে গুজরাট অভিযানে প্রেরণ করেন। গুজরাটের তৎকালীন রাজা ছিলেন দ্বিতীয় রায় কর্ণদেব। সুলতানের বাহিনীর আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাজা রায় কর্ণদেব তার কন্যা দেবলাদেবীকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র দেবের রাজপ্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুলতানের বাহিনী রাজধানী আনহিলওয়ারাসহ সমগ্র গুজরাট ও ক্যাম্বে হস্তগত করেণ। রানী কমলাদেবীসহ কাফুর নামক একজন খোজাকে বন্দি করে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি রানী কমলাদেবীকে বিবাহ করেন। আর খোজা কাফুর-পরবর্তীতে মালিক কাফুর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন । তিনি আলাউদ্দিন খলজির প্রধান সেনাপতি ও অমাত্যের পদ অলংকৃত করেন।
রণথম্ভোর বিজয়
দিল্লির দুর্বল শাসকদের অযোগ্যতার সুযোগে রাজপুতগণ পুনরায় রণথম্ভোর দখল করে নেয়। এই সময় রণথম্ভোরের শাসক ছিলেন দ্বিতীয় চৌহানরাজ হামির দেব। সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী মুহাম্মদ শাহসহ অনেক নব মুসলমানকে তার রাজ্যে আশ্রয় প্রদান করে হামির দেব সুলতান আলাউদ্দিন খলজির বিরাগ ভাজন হন। আলাউদ্দিন ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ খান ও নুসরাত খানের নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর সুলতান নিজে এক বিশাল

 

 

 


সেনাবাহিনী নিয়ে রণথম্ভোরের উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা করেন। সুলতানের বাহিনী দীর্ঘ এক বছর রণথম্ভোর অবরোধ করে রাখার পর ১৩০১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে রণথম্ভোর দুর্গ জয় করে নেয়। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি রাজা হামির দেবকে সপরিবারে হত্যা করেন। নব-মুসলমানদেরকেও হত্যা করা হয়। সুলতান তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি উলুঘ খানকে রণথম্ভোরের শাসক নিযুক্ত করেন এবং বিপুল ধন রত্ন সহকারে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
চিতোর বিজয়
রাজপুতনার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ছিল মেবার। আর মেবারের রাজধানী চিতোর ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং দুর্ভেদ্য। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট আলাউদ্দিন খলজি স্বয়ং এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে চিতোর আক্রমণ করেন। রাজপুত রাণা রতন-সিংহের পদ্মিনী নামে এক অনিন্দ্য সুন্দরী পত্নী ছিল। জনশ্রুতি আছে যে, পদ্মিনীকে লাভের জন্য সুলতান আলাউদ্দিন খলজি মেবার অভিযান করেন। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা পদ্মিনী উপাখ্যানের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। উভয় বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে রাজপুত বীর গোরা ও বাদল বীরত্ব প্রদর্শন করা সত্ত্বেও রাণা রতন সিংহ রাজকীয় বাহিনীর হাতে পরাজিত এবং বন্দী হন। রাজপুত রমনীগণ আত্মসম্ভ্রম রক্ষার্থে ঝুলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মবিসর্জন দেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথা ‘জহরব্রত' নামে পরিচিত ছিল । আলাউদ্দিন খলজি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র খিজির খানকে চিতোরের শাসনভার অর্পণ করেন। যুবরাজ খিজির খানের নামানুসারে চিতোরের নামকরণ করেন খিজিরাবাদ। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ খিজিরখান চিতোর ত্যাগ করলে সুলতান জালোরের অধিপতি মালদেবকে চিতোরের শাসক নিয়োগ করেন। ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি মৃত্যুবরণ করেন। ১৩১৮ খ্রিস্টাব্দে চিতোরের শাসক মালদেবকে বিতাড়িত করে রাজপুত রাণা হামির চিতোর পুনঃদখল করেন।
মালব বিজয়
উত্তর ভারতের গুজরাট, রণথম্ভোর ও চিতোর বিজয়ের পর সুলতান আলাউদ্দিন খলজি মালব বিজয়ে অগ্রসর হন। এসময় মালবের শাসক ছিলেন রায় মাহল দেব। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি আইন-উল-মুলককে সেনাবাহিনীসহ মালবের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। রাজকীয় বাহিনীর সাথে রায় মাহল দেবের বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে রায় মাহল দেব পরাজিত ও নিহত হন। এরপর উজ্জয়িনী, চান্দেরী, মান্ডু, ধর প্রভৃতি অঞ্চল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সুলতান আলাউদ্দিন বিজয়ী সেনাপতি আইন-উল-মুলককে মালবের শাসক নিযুক্ত করেন। ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র উত্তর ভারতে সুলতান আলাউদ্দিন খলজির আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
আলাউদ্দিন খলজির দক্ষিণ ভারত বিজয়
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য,ধনরত্নের প্রাচুর্য এবং অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ প্রভৃতি সুলতান আলাউদ্দিন খলজিকে দক্ষিণ ভারত তথা দাক্ষিণাত্য বিজয়ে উৎসাহিত করে। দাক্ষিণাত্য অভিযানে সুলতান আলাউদ্দিন খলজির প্রধান সমর নায়ক ছিলেন মালিক কাফুর ।
দেবগিরি অভিযান
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে দেবগিরির শাসক ছিলেন রাজা রামচন্দ্র দেব। রামচন্দ্র দেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইলিচপুর প্রদেশের কর প্রেরণ করেননি এবং সুলতানের নিকট উপঢৌকন প্রেরণ বন্ধ করে
দেন। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল যে, তিনি গুজরাটের পরাজিত রাজা কর্ণদেবকে তাঁর কন্যা দেবলা দেবীসহ আশ্রয় প্রদান করেন। সুলতান আলাউদ্দিন ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সেনাপতি মালিক কাফুরকে দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র দেবের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। রাজা রামচন্দ্র দেব সুলতানের বাহিনীর নিকট পরাজিত হন এবং বশ্যতা স্বীকার করেন। তার এরূপ ব্যবহারে খুশী হয়ে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি রাজা রামচন্দ্র দেবকে ‘রায়-রায়ন’ উপাধি প্রদান করেন। সেনাপতি মালিক কাফুর বিপুল ধন সম্পদসহ গুজরাটের রাজকন্যা দেবলা দেবীকে নিয়ে রাজধানী দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র খিজির খানের সাথে দেবলা দেবীর বিবাহ প্রদান করেন।
বরঙ্গল বিজয়
‘বরঙ্গল' ছিল তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী। বরঙ্গলে এসময় কাকতীয় বংশের শাসন প্রচলিত ছিল। কাকতীয় বংশের শাসক রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র দেবের বিরুদ্ধে ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন সেনাপতি মালিক কাফুরকে প্রেরণ করেন। প্রায় দুই বছর অবরুদ্ধ থাকার পর ১৩১০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র দেব সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করেন। রাজা সুলতানের জন্য বিপুল উপঢৌকন প্রেরণ করেন এবং বাৎসরিক কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন ।
 

 

 


দেবগিরি এবং বরঙ্গল রাজ্য বিজয়ের পর আলাউদ্দিন খলজি দাক্ষিণাত্যের শেষ সীমা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।
দ্বার সমুদ্র বিজয়
দাক্ষিণাত্যের হোয়সলরাজ তৃতীয় বীর বল্লালের রাজধানী ছিল দ্বার সমুদ্র। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত সেনাপতি মালিক কাফুর এর নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী তৃতীয় বীর বল্লালের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির মিত্র দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র, বরঙ্গলের রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র দেব এবং মালিক কাফুরের নেতৃত্বে সুলতানের বাহিনী সম্মিলিতভাবে হোয়সলরাজকে আক্রমণ করলে রাজা বীর বল্লাল অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে যুদ্ধের সমস্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন এবং সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করেন। ফলে হোয়সল রাজ্য দিল্লির সালতানাতের সরকারের অধীনস্ত হয় এবং নিয়মিত করদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
পান্ডরাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান
দ্বার সমুদ্রের দক্ষিণে অবস্থিত পান্ডরাজ্যের রাজধানী ছিল মাদুরা। পান্ডরাজ্যের রাজার মৃত্যুর পর বীর পান্ড ও সুন্ড পান্ডের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি সেনাপতি মালিক কাফুরকে পান্ডরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ভ্রাতৃবিরোধের সুযোগে মালিক কাফুর অতিসহজেই পাণ্ডরাজ্য অধিকার করেন। সেনাপতি কাফুর রামেশ্বর পর্যন্ত দখল করেন। তিনি রামেশ্বরে সুলতান আলাউদ্দিন খলজির নামানুসারে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে মালিক কাফুর বিপুল ধনসম্পদসহ দিল্লিতে প্রত্যাবতন করেন।
শংকর দেবের বিরুদ্ধে অভিযান
দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র দেব ছিলেন দিল্লি সালতানাতের প্রতি বিশেষভাবে অনুগত। ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর পুত্র শংকর দেব সিংহাসনে আরোহণ করে দিল্লিতে কর প্রেরণ বন্ধ করে দেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে শংকর দেবের বিরুদ্ধে এক সমরাভিযান প্রেরণ করলে শংকর দেব যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে পুনরায় দেবগিরি রাজ্য দিল্লির শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে ১৩১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে সুলতান আলাউদ্দিন খলজির কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলাফল
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূর প্রসারী। ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৩১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে প্রেরিত প্রায় সব অভিযান সফলতার সাথে সমাপ্ত হয়। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ কলহ ও বিবাদের সুযোগে সেনাপতি মালিক কাফুর দক্ষিণ ভারত জয় করতে সক্ষম হন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি উত্তর ভারতের বিজিত রাজ্যসমূহ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বিদ্রোহপ্রবণ দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোকে সরাসরি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেননি। নিয়মিত কর দেওার শর্তে দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় শাসকদেরই ক্ষমতায় বহাল রেখেছিলেন তবে এই অভিযান থেকে সেনাপতি মালিক কাফুর বিপুল উপঢৌকন সহকারে রাজধানী দিল্লিতে ফিরে আসেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বীরত্বের সেনাপতি মালিক কাফুরকে ‘মালিক নায়েব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দাক্ষিণাত্য হতে আহরিত অগণিত ধন সম্পদ উত্তর ভারতে মুদ্রাস্ফীতির সূচনা করে, বাধ্য হয়ে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে মূল্যনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
শিক্ষার্থীর কাজ আলাউদ্দিন খলজির দক্ষিণ ভারত বিজয় সংক্ষেপে শ্রেণি কক্ষে আলোচনা করুন ।
সারসংক্ষেপ :
দিল্লি সালতানাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক সুলতান আলাউদ্দিন খলজি পিতৃব্য ও শ্বশুর জালাল উদ্দিন ফিরোজ খলজি কে হত্যা করে ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজ্য বিজয়ের এক দুর্বার প্রত্যাশা নিয়ে ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উত্তর ভারতের গুজরাট, রণথম্ভোর, মেবার, মালব, উজ্জয়িনী, ধর, চান্দেরীসহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করেন। ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৩১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুযোগ্য সেনাপতি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে দেবগিরি, বরঙ্গল, দ্বারসমুদ্র, পান্ডরাজ্য এবং শংকরদেবের রাজ্যসহ রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের এক
 

 


পাঠ-২.৭
আলাউদ্দিন খলজির শাসন সংস্কার ও কৃতিত্ব
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
আলাউদ্দিন খলজির শাসন সংস্কার সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন
আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব সংস্কার সম্পর্কে জানতে পারবেন
আলাউদ্দিন খলজির সামরিক সংস্কার সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
শাসন সংস্কার মালিকা-ই-জাহান, আরিজ-ই-মামালিক, ‘দাগ' ও ‘হুলিয়া’
সুলতান আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬খ্রি:) ভারতের মধ্য যুগের ইতিহাসে শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতাই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ প্রশাসক। বিজিত অঞ্চলে তিনি যুগোপযোগী সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের ন্যায় সুলতান আলাউদ্দিন খলজিও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রভাবশালী ও ক্রিয়াশীল উলেমা ও অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রভাব ক্ষুণ্ন করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালে সম্রাট আকবর ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে সুলতান আলাউদ্দিন খলজিকে অনুসরণ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বিজিত অঞ্চলে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে সাম্রাজ্যে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন। তিনি নিজেকে ‘ইয়ামিন-উল-খিলাফত’ ও ‘ নাসিরী আমির- উল-মুমেনিন’ হিসেবে অভিহিত করেন। সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি জালাল উদ্দিন খলজির বিধবা পত্মী মালিকা-ই-জাহান, পুত্র রুকনউদ্দিন ইব্রাহিম, হাজী মওলা, ভ্রাতুষ্পুত্র আকত খান, নও মুসলিম উমর খান ও মঙ্গু খান এবং অভিজাত শ্রেণির ব্যাপক বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিলেন। উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার পর বিদ্রোহের চারটি কারণ উদঘাটিত হয়। এগুলো হলো-
(১) রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা এবং শাসনকার্য সম্পাদনে সুলতানের অমনোযোগিতা ও ঔদাসীন্য,
(২) মাদক দ্রব্যের অপরিমিত প্রচলন, (৩) আমির, মালিক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সুসম্পর্ক, পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং অবাধ মেলামেশা ও
(৪) অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য।
বিদ্রোহের কারণ চিহ্নিত করার পর তার মূলোৎপাটন করতে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ
করেন।
প্রথমত, শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে প্রশাসনিক কার্যাবলীর দায়িত্ব আমির ও উমারাহদের উপর ন্যস্ত না করে সুলতান নিজেই এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়ত, সুলতান মাদক জাতীয় দ্রব্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং অবাধ সরবরাহ নিষিদ্ধ করেন। জনসাধারণকে
উদ্বুদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে সুলতান নিজেই মদ্যপান ত্যাগ করেন এবং সমস্ত পান-পাত্র ভেঙে ফেলেন। তৃতীয়ত, সুলতানের বিনা অনুমতিতে আমির, মালিক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, সামাজিক উৎসব, আমোদ-প্রমোদ, ভোজসভা এবং অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিজাত সম্প্রদায়ের কার্যকলাপের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যের সর্বত্র সুলতান অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করেন ।
চতুর্থত, সুলতান আলাউদ্দিন খলজি বিশ্বাস করতেন যে, সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেই জনসাধারণের মনে বিদ্রোহের মনোবৃত্তি উদ্রেক করে। তিনি আমির, মালিক, অভিজাত সম্প্রদায় ও বিত্তবান হিন্দুদের জায়গীর ও নিষ্কর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং বখশিস, পেনশন, ভাতা প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেন। ফলশ্রুতিতে হিন্দু-মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়ের
 

 

 

 

 


পাঠ-২.৮
তুঘলক বংশ ও মুহাম্মদ বিন তুঘলক
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা অর্জন করতে পারবেন; সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের পাঁচটি পরিকল্পনা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন ও
সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের কার্যাবলি মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
প্ৰেক্ষাপট কারাউনা তুর্কি, উলুঘ খান, আমির-ই-আখুর, আমির-ই-কোহী ও দিওয়ান-ই-কোহী
১৩১৬ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি সুলতান আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর পর ‘মালিক তাজ-উল-মালিক কাফুরী’ উপাধি প্রাপ্ত এবং ‘হাজার দিনারী' খ্যাত প্রধানমন্ত্রী মালিক কাফুর সুলতানের পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুপুত্র শিহাবউদ্দিন ওমরকে দিল্লির মসনদে বসান এবং নিজে তাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন। তিনি সুলতানের অপর দুই পুত্র খিজির খান ও সাদী খানের চক্ষু উৎপাটন করে তাদেরকে কারারুদ্ধ করেন এবং আলাউদ্দিনের বিধবা স্ত্রীকে জোরপূর্বক বিবাহ করেন। কিন্তু মালিক কাফুরের স্বৈরাচারী শাসন সকল সীমা অতিক্রম করলে অভিজাত শ্রেণির বিশেষ সহায়তায় সুলতানের দেহরক্ষীরা ৩৬ দিন পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর সুলতান আলাউদ্দিন খলজির তৃতীয় পুত্র মুবারক ‘কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ' উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু মুবারক শাহ ছিলেন অলস, অকর্মণ্য ও ভোগবিলাসী। তিনি বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে রাজ্যের সমস্ত শাসনভার দাক্ষিণাত্যের শাসন কর্তা খসরু খানের উপর ন্যস্ত করেন। এমনকি তিনি পিতা আলাউদ্দিন খলজির শাসন ব্যবস্থার কঠোর নীতি শিথিল করেন। তিনি অনেক আইন কানুন বাতিল করে উদারতার পরিচয় প্রদানে সচেষ্ট হন। তিনি ‘খলিফা' উপাধিও ধারণ করেন। এমতাবস্থায় সাম্রাজ্যের সর্বত্র অরাজক পরিস্থিতির সুযোগে খসরু খান মুবারক শাহকে হত্যা করে দিল্লির মসনদে আরোহণ করেন। তিনি নাসিরউদ্দিন খসরু শাহ উপাধি ধারণ করেন। সমসাময়িককালের মুসলিম ঐতিহাসিকগণ খসরু শাহের শাসনকালকে সন্ত্রাসের রাজত্ব বলে চিহ্নিত করেছেন।
খসরু খানের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে দিল্লির অভিজাত আমির উমারাহগণ পাঞ্জাবের অন্তর্গত দীপালপুরের শাসক গাজী মালিককে দিল্লির মসনদ দখলের জন্য আহ্বান করেন। ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে গাজি মালিক দিল্লির উপকণ্ঠে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে খসরু খানকে পরাজিত ও নিহত করেন। গাজী মালিক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক উপাধি ধারণ করে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি ছিলেন তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তুঘলক বংশকে ‘কারাউনা তুর্কি বংশ নামেও অভিহিত করা হয়। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক, মুহম্মদ বিন তুঘলক এবং ফিরোজশাহ তুঘলক ছিলেন এই বংশের তিনজন শ্রেষ্ঠ সুলতান। ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বংশের সর্বমোট ৯জন শাসক প্রায় ৯৩ বছর যাবৎ ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেন।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক (১৩২০-১৩২৫খ্রি.)
গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের বাল্য নাম ছিল গাজী তুঘলক। তিনি ছিলেন কারাউনা তুর্কি গোষ্ঠীর অন্তর্গত। গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের পরিবার সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে দিল্লিতে আসেন। তার পিতা বলবনের অধীনে একজন তুর্কি দাস হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পাঞ্জাবের এক জাঠ রমণীকে বিবাহ করেন। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ধমনীতে তাই তুর্কি ও রাজপুত রক্তের যৌথ উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী গিয়াসউদ্দিন তুঘলক একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও স্বীয় মেধা, প্রতিভা, দৃঢ় মনোবল এবং প্রবল আত্মবিশ্বাসের গুণে সুলতান আলাউদ্দিন খলজির অধীনে ‘সেনাবাহিনীর প্রধান রক্ষক' পদে নিযুক্ত হন। ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খলজি তাঁকে পাঞ্জাবের অন্তর্গত দীপালপুরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এসময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রায় ২৯ বার মোঙ্গল আক্রমণ মোকাবিলা করে তিনি সুলতান আলাউদ্দিন খলজির মন:তুষ্টি অর্জন করেন। এতে খুশি হয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিনকে ‘মালিক উল গাজি’ বা ‘গাজি মালিক' উপাধি প্রদান করে। ১৩২০ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর নাসিরউদ্দিন খসরু শাহকে পরাজিত ও নিহত করেন। গাজী মালিক সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক উপাধি ধারণ করে ভারতীয় উপমহাদেশে তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠা
 

 

 


করেন। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দিল্লির ছয় মাইল অদূরে আফগানপুর নামক স্থানে তোরণ ধ্বংসের কারণে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক মৃত্যুবরণ করেন।
মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রি.)ঃ
মুহম্মদ বিন তুঘলকের ঘটনাবহুল রাজত্বকাল 

তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের জ্যেষ্ঠপুত্র ফখরুদ্দিন মুহম্মদ জুনা খান বাল্যকালে সামরিক ও বেসামরিক উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন। একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। খলজি বংশের শাসনামলে সুলতান নাসির উদ্দিন খসরু শাহ জুনা খানকে ‘আমির-ই-আখুর' তথা রাজকীয় অশ্বশালার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। তুঘলক বংশ প্রতিষ্ঠায় জুনা খান পিতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলককে সহায়তা করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক পুত্র জুনা খানকে ‘উলুঘ খান' উপাধি প্রদান করে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে জুনা খান মুহম্মদ বিন তুঘলক উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর মুহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লির সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মুহম্মদ বিন তুঘলক কর্তৃক গৃহীত পাঁচটি পরিকল্পনা হলো-
১. দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৬-১৩২৭খ্রি.); ২. খোরাসান অভিযান (১৩২৭-১৩২৮ খ্রি.);
৩. প্রতীক তাম্র মুদ্রা প্রচলন (১৩২৯-১৩৩০ খ্রি.);
৪. কারাচিল অভিযান (১৩৩২-১৩৩৩ খ্রি.) এবং
৫. দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি (১৩৩৪ খ্রি.)।
১. দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৬-১৩২৭ খ্রি.) কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ক্রমাগত মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা, দাক্ষিণাত্যের ধন-দৌলত, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যের মধ্যস্থলে অবস্থানের কারণে ১৩২৬-২৭ খ্রি. সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি হতে ৭০০ মাইল দূরে অবস্থিত দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। দেবগিরির নতুন নামকরণ করেন দৌলতাবাদ। প্রায় ৮ বছর দৌলতাবাদে অবস্থানের পর সুলতান সবাইকে নিয়ে পুনরায় দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ফলে সুলতানের রাজধানী স্থানান্তর পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২. খোরাসান অভিযান (১৩২৭-১৩২৮ খ্রি.)
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির ন্যায় সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকও ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক। মুহম্মদ বিন তুঘলকের সমসাময়িক পারস্যের ইলখানি শাসক ছিলেন আবু সাঈদ। ১৩২৭-১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক বিভিন্ন কারণে খোরাসান অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে সুলতানের দরবারে আশ্রয়প্রাপ্ত কতিপয় বিদ্রোহী আমিরের প্ররোচনা, ট্রান্সঅক্সিয়ানার মোঙ্গল শাসক তারমাশিরিন এবং মিসরের মামলুক সুলতান আল নাসিরের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস এবং ইলখানি শাসক আবু সাঈদের দুর্বলতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। খোরাসান অভিযানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সুলতান ৩,৭০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং পূর্ণ এক বছর তাদের বেতন ভাতাদি প্রদান করেন। কিন্তু মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, উপযুক্ত সামরিক শক্তির অভাব, ভৌগোলিক অসুবিধা, ট্রান্সঅক্সিয়ানার তারমাশিরিনের ক্ষমতাচ্যুতি, মিসরের সুলতান আল-নাসির ও ইলখানি সুলতান আবু সাঈদের মধ্যে সুস্পর্ক স্থাপন এবং সর্বোপরি হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথে সৈন্য প্রেরণের অসুবিধা প্রভৃতি কারণে সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক খোরাসান অভিযান পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হন।
৩. প্রতীক তাম্র মুদ্রা প্রচলন (১৩২৯-১৩৩০খ্রি.)
বিশাল সেনাবাহিনীর ব্যয় সংকুলান, সুলতানের দানশীলতা, শাসনকার্যে অত্যাধিক ব্যয়, দোয়াব অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ, উত্তর- পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ, রাজ্য বিজয় পরিকল্পনা, দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরজনিত ব্যয়ভার প্রভৃতি কারণে রাজকোষে আর্থিক সংকট দেখা দিলে ১৩২৯-১৩৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতীক তাম্র-মুদ্রা প্রবর্তন করেন। সুলতান ২০০ গ্রেনের স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) এবং ১৪০ গ্রেনের রৌপ্যমুদ্রার (আদালী) প্রবর্তন করেন। এডওয়ার্ড থমাস সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলককে ‘Prince of Moneyers’ বা ‘মুদ্রা প্রবর্তকদের রাজকুমার' উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুলতানের এই পরিকল্পনাও বিফলতায় পর্যবসিত হয়।
 

 

 

 

 


প্রবল বিশ্বাস থাকলেও তিনি ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু। তার শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা রাজকীয় উচ্চপদে নিয়োগ লাভ করে। কৃষক ও কৃষিকাজের উন্নতি সাধনের জন্য সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক ‘দিওয়ান-ই-কোহী' নামক একটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করে ‘আমির-ই-কোহী’র নিকট এর তত্ত্বাবধানের ভার অর্পণ করেন। এই বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদেরকে ‘তাকাভি’ ঋণ প্রদান করা হত। জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য সুলতান অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অপরাধী উচ্চ বংশীয় কিংবা শাসক পরিবারের অন্তর্গত হলেও তাকে শাস্তি দিতে কোনরূপ অনুকম্পা প্রদর্শন করা হতো না ।
শিক্ষার্থীর কাজ
মুহম্মদ বিন তুঘলক কর্তৃক গৃহীত পাঁচটি পরিকল্পনা লিখুন।
সারসংক্ষেপ :
‘কারাউনা তুর্কি’ বংশোদ্ভূত গাজী মালিক (গিয়াসউদ্দিন তুঘলক) ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ঘটনাবহুল রাজত্বকালে দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, খোরাসান অভিযান, প্রতীক তাম্রমুদ্রা প্রচলন, কারাচিল অভিযান এবং দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি তথা পঞ্চ পরিকল্পনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তথাপি নানাবিধ কারণে সুলতানের এসমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মেবারের সৈয়দ জালাল উদ্দিন ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে, পূর্ব বাংলার শাসক ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে এবং উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিম বাংলায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের দৌলতাবাদে স্বাধীন বাহমনী রাজ্য এবং বিজয় নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতান বিদ্রোহদমনরত অবস্থায় ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। নি:সন্দেহে তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভা সম্পন্ন শাসক।
 

 

 


পাঠ-২.৯
ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮খ্রি.)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
ফিরোজ শাহ তুঘলকের সিংহাসনে আরোহণ সম্পর্কে জানতে পারবেন;
ফিরোজ শাহ তুঘলকের বাংলা অভিযান সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন ও
ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনহিতকর কার্যাবলী মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
একডালা দুর্গ, মাতামহী সুলভ ব্যবস্থাপনা, দিওয়ান-ই-খয়রাত ও ফুতুহাত-ই-ফিরোজশাহী
ফিরোজ শাহ তুঘলকের সিংহাসন লাভ
ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তাঁর পিতার নাম ছিল রজব। তিনি ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাঞ্জাবের অন্তর্গত আবোহরের ভাট্টি রাজপুত রায়মলের কন্যা লায়লা (কাদবানু) এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ফিরোজের ধমনীতে ছিল তুর্কি ও রাজপুত রক্তের সংমিশ্রণ। মাত্র ৭ বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগের ফলে ফিরোজ পিতৃব্য গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের নিকট লালিত পালিত হন। সুলতান তাঁকে ধর্মীয়, যুদ্ধবিদ্যা, শাসন সংক্রান্ত ও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক সিন্ধুর তাঘির বিদ্রোহ দমনরত অবস্থায় ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ থাট্টায় অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। সুলতানের মৃত্যুর পর রাজকীয় বাহিনীর মধ্যে চরম অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং উপস্থিত আমির ও অভিজাতবর্গের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ফিরোজ ‘ফিরোজ শাহ তুঘলক' উপাধি ধারণ পূর্বক সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান হওয়ার অব্যবহিত পরই ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজকীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন করেন। গোলযোগ পূর্ব মুহুর্তে মুহম্মদ বিন তুঘলকের সময় খাজা জাহান নামে একজন নায়েব, এক শিশুকে সুলতানের পুত্র বলে ঘোষণা করে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে নিজে তাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন। কিন্তু আমির উমারাহগণের ক্রমাগত বিরোধিতার কারণে খাজা জাহান সুলতানের নিকট অবশেষে আত্মসমর্পণ করেন। তখন সুলতান তাকে সামানার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। দুর্ভাগ্যবশত খাজা জাহান সামানা ও সুনাম অঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ শের খানের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
বাংলায় অভিযান
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে হাজী ইলিয়াস ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ' উপাধি ধারণ করে বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলা, ত্রিহুত, নেপালের কিয়দংশ এবং উড়িষ্যা বিজয় করে বেনারস পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যের সীমানা বর্ধিত করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ৭০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্বয়ং বাংলা অভিযান করেন। ইলিয়াস শাহের রাজধানী ছিল পান্ডুয়া। দিল্লির সুলতানের আগমনের কারণে রাজধানী পাণ্ডুয়া হতে ১০/১২ মাইল দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত একডালা দুর্গে ইলিয়াস শাহ আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ এ ডালা দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু কয়েক মাস একডালা দুর্গ অবরুদ্ধ থাকার পর বর্ষার আগমনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হলে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাধ্য হয়ে সসৈন্যে রাজধানী দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজদরবারের অভ্যন্তরীণ কলহের সুযোগ নিয়ে বাংলার আমির জাফর খানের অনুরোধে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে ৭০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। সিকান্দার শাহ পিতৃ কৌশল অবলম্বন করে সসৈন্যে একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাধ্য হয়ে দীর্ঘকাল অবরোধের পর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক সিকান্দার শাহের সাথে সন্ধি স্থাপন করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
জনহিতকর কার্যাবলী
ফিরোজ শাহ তুঘলক একজন রণকুশলী যোদ্ধা এবং সুদক্ষ সেনাপতি না হলেও তিনি একজন প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। মুহম্মদ বিন তুঘলকের পঞ্চ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার ফলে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় সুলতান ফিরোজ শাহ
 

 

 



তুঘলকের প্রচেষ্টার ফলে তা অনেকটাই প্রশমিত হয়। শামস-ই-সিরাজ আফিফের মতে সুলতান প্রায় ২৩ প্রকার অবৈধ কর রহিত করেন। ইসলাম ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকার কারণে সুলতান কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে চার ধরণের কর ধার্য করেন। এগুলো হলো- (১) খারাজ (২) যাকাত, (৩) জিজিয়া ও (৪) খুমস। ঐতিহাসিক বারানী ফিরোজ শাহ তুঘলককে ভারতের প্রথম সত্যিকারের মুসলিম রাজা বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক আন্ত:প্রাদেশিক শুল্ক উঠিয়ে দেন। জনসাধারণের সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে দ্রব্য মূল্যের সহনীয় মাত্রার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সুলতান ৪টি খাল এবং ১৫০টি কূপ খনন করেন। ফলশ্রুতিতে অনেক অনাবাদি ও পতিত জমি চাষের আওতায় আসে। এছাড়াও তিনি কৃষকদের কৃষি ঋণ প্রদান করে কৃষির উন্নতিতে সহযোগিতা প্রদান করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক ধাতু ও রূপার সংমিশ্রণে ‘আধা' (অর্ধ জিতল) এবং ‘বিক’ (জিতলের এক চতুর্থাংশ) নামক দু'ধরণের মুদ্রার প্রবর্তন করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বিচার ব্যবস্থায় মানবোচিত সংস্কার সাধন করেন। বিচার ব্যবস্থায় শারীরিক অঙ্গচ্ছেদসহ প্রভৃতি নিষ্ঠুর শাস্তি প্রথা রহিত করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন একজন উদার ও জনকল্যাণকর শাসক । জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সুলতান বেশ কয়েকটি মানব কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ইতিহাসে ‘মাতামহী সুলভ ব্যবস্থাপনা' (Grand-Motherly Legislation) নামে পরিচিত। এই বিভাগ থেকে এতিম ও অসহায় মুসলিম মেয়েদের বিবাহের জন্য অর্থ সাহায্য প্রদান করা হতো। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজ্যের বেকার সমস্যা সমাধানকল্পে ‘কর্মসংস্থান সংস্থা' নামে একটি বিশেষ সংস্থা গঠন করেন। দিল্লির কোতোয়ালের মাধ্যমে বেকার যুবকদের খুঁজে বের করে তাদেরকে যোগ্যতানুযায়ী চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দরিদ্র, এতিম, অসহায় বৃদ্ধদের আর্থিক সাহায্য প্রদানের লক্ষ্যে সুলতান ‘দিওয়ান-ই-খয়রাত' নামক সরকারি সাহায্য দপ্তর স্থাপন করেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা প্রদানের জন্য সুলতান ইতিহাস প্রসিদ্ধ একটি চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা দারুল শেফা বিমারিস্তান নামে সর্বজন পরিচিত। এই দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে রোগীদের মধ্যে চিকিৎসা সেবা এবং ঔষধ সরবরাহ করা হত। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক নির্মাতা হিসেবেও ইতিহাসে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। বাংলা অভিযানের সময় তিনি এলাকার নামকরণ করেন আজাদপুর এবং পাণ্ডুয়ার নামকরণ করেন ফিরোজাবাদ। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি নতুন শহর স্থাপন করেন যেগুলোর মধ্যে ফতেহাবাদ, হিসার, জৌনপুর, ফিরোজপুর প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও সুলতান ৪টি মসজিদ, ৩০টি প্রাসাদ, ২০০টি সরাইখানা, ৫টি খাল, ৪টি হাসপাতাল, ১০০টি কবর, ১০টি স্নানাগার, ১৫৩টি কূপ, ১০টি স্মৃতিস্তম্ভ এবং ১০০টি সেতু নির্মাণ করেন। সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক সেনাবাহিনীর সংস্কার সাধন করেন। নিয়মিত সৈন্যদেরকে নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর প্রদান করা হতো এবং অনিয়মিত সৈন্যদেরকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নগদ বেতন দেওয়া হত। সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল আশি থেকে নব্বই হাজার। ক্রীতদাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণ-পোষণের জন্য সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ‘দিওয়ান-ই-বন্দেগান' নামক একটি ক্রীতদাস বিভাগ সৃষ্টি করেন। তাঁর সময়ে ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৮০,০০০ জন। সুলতান ক্রীতদাসদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক জ্ঞানী-গুণী ও পন্ডিত ব্যক্তিদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা ছিলেন। সুলতানের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ফুতুহাত-ই- ফিরোজ শাহী' রচনায় লেখকের প্রতি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর ৮০ বছর বয়সে ফিরোজ শাহ তুঘলক মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষার্থীর কাজ
সারসংক্ষেপ :
ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিভিন্ন অভিযান সম্পর্কে লিখুন।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন একজন প্রজাদরদী মহান শাসক। রাজ্য বিজয় অপেক্ষা রাজ্যের জনসাধারণের জন্য একটি কল্যাণকর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে তিনি বেশি মনোযোগী ছিলেন। সুলতান প্রজার উপকারে ২৩ প্রকারের কর রহিত করে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে ৪ ধরণের কর প্রবর্তন করেন। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য সুলতান আন্তপ্রাদেশিক শুল্ক প্রত্যাহার করে নেন। ভারতবর্ষ একটি কৃষি প্রদান দেশ এ বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি বিভিন্ন খাল ও কূপ খনন করেন এবং কৃষকদেরকে প্রয়োজনে কৃষিঋণ প্রদান করেন। বিচার ব্যবস্থায় মানবোচিত সংস্কার সাধন করে বিচার ব্যবস্থাকে উদার ও জনকল্যাণকর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সুলতান ‘মাতামহী
 

 

 


পাঠ-২.১০
সৈয়দ বংশ (১৪১৪-১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
সৈয়দ বংশের পরিচয় দিতে পারবেন ও
সৈয়দ বংশের শাসকদের শাসনকাল সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
সৈয়দ, তৈমুর লঙ, রায়াত-ই-আলা, মোবারকবাদ ও তারিখ-ই-মোবারকশাহী
সৈয়দ বংশের পরিচয়
দিল্লি সালতানাতের পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী রাজবংশ ছিল সৈয়দ বংশ। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে খিজির খান এই বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের অধিবাসী দুর্ধর্ষ বিজেতা তৈমুর লঙ এক বিশাল তুর্কি সৈন্যবাহিনী নিয়ে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত আক্রমণ করেন। ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ অগণিত লুণ্ঠিত দ্রব্য, যুদ্ধবন্দী এবং কতিপয় বিখ্যাত শিল্পীসহ সমরকন্দে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে খিজির খানকে লাহোর, মুলতান ও দিপালপুরের শাসনভার অর্পণ করেন। অর্থাৎ সমরকন্দের অধীনে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন খিজির খান। সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ ছিলেন তুঘলক বংশের সর্বশেষ সুলতান। তিনি ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির সুলতান ছিলেন। ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের পতনের পর প্রায় দুই শত বছরের তুর্কি শাসনের অবসান ঘটে। দিল্লির অভিজাত শ্রেণি, আমির, উমারাহ এবং মালিকগণ দৌলত খান নামক জনৈক ব্যক্তিকে দিল্লির শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে আমির তৈমুর লঙ কর্তৃক নিযুক্ত মুলতান, লাহোর এবং দিপালপুরের শাসক খিজির খান অকস্মাৎ দিল্লি আক্রমণ করে দৌলত খানকে পরাস্ত করলে তিনি খিজির খানের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে খিজির খান সুলতান হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সৈয়দ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। খিজির খান, মুবারক শাহ, মুহাম্মদ শাহ এবং আলাউদ্দিন আলম শাহ ছিলেন সৈয়দ বংশের চারজন সুলতান। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩৭ বছর সৈয়দ বংশের শাসকেরা শাসন করে। সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান খিজির খান নিজেকে হজরত মুহাম্মদ (স.) এর বংশধর বলে দাবি করতেন। তাই ইতিহাসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বংশ সৈয়দ বংশ নামে পরিচিত।
খিজির খান (১৪১৪-১৪২১ খ্রি.)
সৈয়দ বংশের ইতিহাসে অন্যতম সফল শাসক ছিলেন খিজির খান। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী খিজির খান মুলতানের শাসক মালিক নাসির উল মুলক এর নিকট লালিত পালিত হন। খিজির খান ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে দৌলত খানকে পরাজিত করে সৈয়দ বংশের গোড়াপত্তন করেন। কোন ধরণের রাজকীয় উপাধি গ্রহণ না করে শুধুমাত্র ‘রায়াত-ই-আলা’ উপাধি গ্রহণ করে খিজির খান প্রথমে আমির তৈমুরের এবং তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র শাহরুখের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। তিনি কামপিল, পাতিয়ালা, গোয়ালিয়র, এটোয়া এবং মেওয়াট প্রভৃতি অঞ্চলে সফলতার সাথে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। খিজির খান ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রজাবৎসল, ধার্মিক, দয়ালু এবং ন্যায় পরায়ণ শাসক। এই সফল শাসক ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজ পুত্র মুবারক শাহকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করেন ।
মুবারক শাহ (১৪২১-১৪৩৪খ্রি.)
খিজির খানের মৃত্যুর পর তাঁর মনোনয়ন অনুযায়ী তাঁর পুত্র ‘মুবারক শাহ' উপাধি ধারণ পূর্বক ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ বংশের দ্বিতীয় শাসক হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পর সাম্রাজ্যের সর্বত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। উত্তর- পশ্চিম সীমান্তে পাঞ্জাবের খোক্কার উপজাতির বিদ্রোহী নেতা জাসরাত রাজধানী দিল্লি অধিকার করার দুরভিসন্ধি করেন। উল্লিখিত সময়ে ভাতিন্দা ও দোয়াব অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হলে মুবারক
 

 

 

 

 


পাঠ-২.১১
লোদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬ খ্রি.)
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি--
লোদী বংশের পরিচয় ও বাহলুল লোদী সম্পর্কে জানতে পারবেন;
সিকান্দার লোদীর শাসনকাল সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন; ও ইব্রাহিম লোদী সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
লোদী, খান-ই-খানান, নিজাম খান, জালালী শহর ও তিব্বী সিকান্দারী
লোদী বংশের পরিচয়
দিল্লি সালতানাতের অন্যতম প্রভাবশালী এবং সর্বশেষ রাজবংশ ছিল লোদী বংশ। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাহলুল খান লোদী। তিনি সুলতানি শাসন ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। সৈয়দ বংশের সর্বশেষ সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ এবং প্রধান মন্ত্রী হামিদ খানের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সুলতান পাঞ্জাবের প্রতাপশালী শাসনকর্তা বাহলুল খান লোদীকে আমন্ত্রণ জানান। বাহলুল লোদী ও সুলতানের সম্মিলিত শক্তি হামিদ খানকে পরাজিত ও নিহত করে। এই ঘটনার পর শক্তিশালী শাসক বাহলুল লোদী দিল্লি দখল করে নেন। বাধ্য হয়ে সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ বাহলুল লোদীর হাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা অর্পণ করে তাঁর প্রিয় স্থান বদাউনে গমন করে সেখানে অবসর জীবন যাপন করেন। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল বাহলুল লোদী নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করে মধ্যযুগীয় ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম প্রভাবশালী রাজবংশ লোদী বংশের গোড়াপত্তন করেন। বাহলুল লোদী, সিকান্দার লোদী এবং ইব্রাহিম লোদী ছিলেন এই বংশের তিনজন সুলতান। তাঁরা ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইব্রাহিম লোদী ছিলেন লোদী বংশের এবং সেই সাথে দিল্লি সালতানাতের সর্বশেষ সুলতান। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল ঐতিহাসিক পানি পথের প্রথম যুদ্ধে কাবুলের অধিপতি ও পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর সুলতান ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত ও নিহত করেন। ফলে লোদী বংশসহ দিল্লি সালতানাতের অবসান ঘটে। ভারতবর্ষের মানচিত্রে আবির্ভূত হয় মুঘল বংশ।
বাহলুল লোদী (১৪৫১-১৪৮৯ খ্রি.)
বাহলুল লোদীর পিতামহের নাম মালিক বাহরাম। তুঘলক বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে মালিক বাহরাম মুলতানের তৎকালীন শাসক মালিক মর্দান দৌলতের নিকট চাকরি গ্রহণ করেন। খিজির খান ছিলেন সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান। তাঁর শাসনামলে বাহলুল লোদীর পিতা মালিক খান এবং পিতৃব্য ইসলাম খান (সুলতান শাহ) রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইসলাম খান মৃত্যুবরণ করলে বাহলুল লোদীকে সিরহিন্দ ও লাহোরের শাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। সৈয়দ বংশের তৃতীয় শাসক মুহম্মদ শাহের শাসনামলে মালব অঞ্চলের বিখ্যাত শাসনকর্তা মাহমুদ শাহ খলজী বিদ্রোহ করলে সিরহিন্দ ও লাহোরের শাসনকর্তা বাহলুল লোদী তাঁকে পরাজিত করে বিতাড়িত করেন। এতে সুলতান মুহম্মদ শাহ সন্তুষ্ট হয়ে বাহলুল লোদীকে ‘খান-ই-খানান’ উপাধি প্রদান করেন। সৈয়দ বংশের সর্বশেষ শাসক আলাউদ্দিন আলম শাহ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করলে বাহলুল লোদী ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল দিল্লির মসনদে আরোহণ করে লোদী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, বাহলুল লোদী ছিলেন আফগান জাতির লোদী উপদলভুক্ত লোক। বাহলুল লোদী জৌনপুরের শাসক মাহমুদ শাহ শরকীর দিল্লি আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যর্থ করে তাঁর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। সাম্বালের দরিয়া খান লোদী, সুকেতের মুবারক খান, মেওয়াটের আহমদ খান, রেওয়াবীর কুতুব খান, ঈশা খান প্রমুখ এবং চান্দওয়ার, এটোয়া ও দোয়াবের সামন্ত রাজগণ সুলতান বাহলুল লোদীর নিকট আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাহলুল লোদী জৌনপুরকে দিল্লি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বরবক শাহকে জৌনপুরের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি পাঞ্জাবকে দিল্লি সালতানাতের অধীনে নিয়ে আসেন। ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালিয়রের রাজা কিরাত
 

 

 


সিংহও বাহলুল লোদীর নিকট আনুগত্য স্বীকার করেন। ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ অবস্থায় সুলতান বাহলুল লোদী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সংস্কৃতি একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। সুলতান বাহলুল লোদী ছিলেন লোদী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান। চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা, বহুমুখী প্রতিভা এবং রাজ্যশাসন পদ্ধতি বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে এটি প্রতীয়মান হয় যে, ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে উপবেশনকারী সুলতানদের মধ্যে বাহলুল লোদী ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ।
সিকান্দার লোদী (১৪৮৯-১৫১৭খ্রি.) লোদী বংশের দ্বিতীয় সুলতান সিকান্দার লোদী ছিলেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল নিজাম খান। সুলতান বাহলুল লোদীর মৃত্যুর পর এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এসময় আমির উমারাহদের প্রাথমিক বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজাম খান ‘সিকান্দার শাহ লোদী' উপাধি ধারণ করে ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরে জৌনপুরের শাসক এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বরবক শাহ সুলতানের আনুগত্য অস্বীকার করে জৌনপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সিকান্দার লোদী বিদ্রোহী ভ্রাতাকে অপসারণ করে তাঁকে কারারুদ্ধ করেন এবং তদস্থলে নতুন শাসনকর্তা নিয়োগ প্রদান করেন। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দূরীভূত করে সুলতান সিকান্দার লোদী ত্রিহুত, বিহার প্রভৃতি অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে সাম্রাজ্যের সীমা বর্ধিত করেন। ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসক সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সাথে সুলতান সিকান্দার লোদী এক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইতিহাস প্রসিদ্ধ আগ্রা নগরীর গোড়াপত্তন করে সেখানে রাজধানী স্থানান্তর করেন। সুলতান সিকান্দার লোদী ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আগ্রা শহরে মৃত্যুবরণ করেন। লোদী বংশের অন্যতম সফল শাসক সুলতান সিকান্দার লোদী ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা, ন্যায় পরায়ণ সমরকুশলী এবং প্রজাবৎসল শাসক। তিনি ছিলেন দরিদ্র প্রজা সাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল, জ্ঞানী-গুণী ও পন্ডিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ন্যায় বিচারের মূর্ত প্রতীক এবং সদা সত্য ও ন্যায়ের অনুসারী। জনগণের আর্থিক সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে সুলতান সিকান্দার লোদী শস্যকর এবং অভ্যন্তরীণ শুল্ক রহিত করেন। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য সুলতান প্রয়োজনীয় পদক্ষেণ গ্রহণ করেন। সুলতান স্বয়ং একজন কবি ছিলেন। তিনি ফারসি ভাষায় কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি এমনকি সাহিত্য ও চিকিৎসা শাস্ত্রেরও একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুলতান সিকান্দার লোদীর বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত ভাষায় লিখিত চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘তিব্বী সিকান্দারী’ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন।
ইব্রাহিম লোদী (১৫১৭-১৫২৬খ্রি.)
ইব্রাহিম লোদী ছিলেন সুলতান সিকান্দার লোদীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি ছিলেন লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর সুলতান সিকান্দার লোদীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইব্রাহিম লোদী, সুলতান ‘ইব্রাহিম শাহ' উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর কুচক্রী অভিজাত শ্রেণির একটি দল সুলতানের কনিষ্ঠ ভাই জালাল উদ্দিনকে জৌনপুরের সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন। সুলতান ইব্রাহিম লোদী প্রভাবশালী অভিজাত ফতেহ খান ও খান জাহানের সাহায্যে বিদ্রোহী ভ্রাতা জালাল উদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করেন। ইব্রাহিম লোদীর উদ্ধত ব্যবহার ও কঠোর নিয়মনীতির ফলে আফগান অভিজাত শ্রেণি ক্ষুদ্ধ হয়। সুলতান আফগান অভিজাতদের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেন। সুলতান ইব্রাহিম লোদীর কঠোরনীতি ও নিষ্ঠুর আচরণে অসন্তুষ্ট আফগান আমির উমারাহদের বিশেষ অনুরোধে পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খান লোদী, ইব্রাহিম লোদীর পিতৃব্য আলম খান এবং রাজপুতনার মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের সম্মিলিত শক্তি কাবুলের অধিপতি বিখ্যাত সমরনেতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরকে ভারত আক্রমণ করতে আহবান করেন। বাবর এই আহবানে সাড়া দিয়ে ভারত আক্রমণ করেন এবং ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল বংশের গোড়াপত্তন করেন। সুলতান ইব্রাহিম লোদী ছিলেন একজন বুদ্ধিমান, নির্ভীক এবং সাহসী সুলতান। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক এবং দানশীল শাসক। পিতা সিকান্দার লোদীর ন্যায় সুলতান ইব্রাহিম লোদীও ছিলেন সঙ্গীতের প্রতি আসক্ত। মানুষ হিসেবে তিনি উদার ও দয়ালু হলেও শাসক সুলভ দুর্বলতার কারণে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রি.) বাবরের হাতে তাঁর পতন ঘটে। আর এর ফলে দিল্লির সুলতানি শাসনের অবসান ঘটে।

 

 

 


পাঠ-২.১২
সুলতানি আমলে ভারতের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
সুলতানি আমলে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানার উৎস সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন; সুলতানি আমলে ভারতের সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন ও
সুলতানি আমলে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারবেন।
মূখ্য শব্দ
‘রিহালা-ই-ইবনে বতুতা', আশরাফ, আতরাফ, বর্ণভেদ প্রথা, জিম্মি ও জিজিয়া
সুলতানি আমলে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস
সুলতানি আমলে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানার উৎস অপ্রতুল। তবে সুলতানি আমলে আগমনকারী বদেশী পর্যটকদের মনোজ্ঞ ও তথ্যপূর্ণ বিবরণ থেকে ভারতের তৎকালীন অর্থনৈতিক ইতিহাস জানা যায়।
সুলতানি আমলে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা
ভারত মূলত: একটি কৃষি প্রধান দেশ। সুলতানি আমলে ভারতের প্রধান আয়ের উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব। কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে দিল্লির সুলতানগণ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ৫টি খাল এবং ১৫৩টি কূপ খনন করেন। এর ফলে অসংখ্য পতিত ও অনাবাদী ভূমি কৃষির আওতাধীনে আসে। এছাড়াও কৃষিঋণ এবং অন্যান্য কৃষি সহায়তা প্রদান করে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক কৃষির প্রভূত উন্নতি বিধান করেন। বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনানুযায়ী সুলতানি আমলে ভারতের শহর ও গ্রামাঞ্চলে সুলতানদের অনুপ্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের ফলে শিল্প-বাণিজ্যের যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটেছিল । সুলতানি আমলে ভারতে তাঁতশিল্পের বিকাশ ঘটে । সুলতান ও অভিজাত শ্রেণীর চাহিদানুযায়ী শুধুমাত্র দিল্লিতে সরকারি কারখানায় প্রায় চার হাজার তাঁতী নিয়োগ করা হয়েছিল। এ সময় ভারতের অধিবাসীদের প্রধান জীবীকা কৃষি হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন শহর, নগর এবং গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরির জন্য শিল্প ও কল-কারখানা গড়ে উঠেছিল। উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল কাপড়, শাড়ী, ধুতি, রেশম ও পশমের বস্ত্র, চিনি এবং কাগজ প্রভৃতি। সুলতানি আমলে বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য, বস্ত্র এবং নানা রকম মসলা ছিল প্রধান রপ্তানিযোগ্য দ্রব্য। বিলাসজাতীয় সামগ্রী, ঘোড়া ও অন্যান্য ভারবাহী পশু বাইরে থেকে আমদানি করা হতো। বাংলা ও গুজরাট হতে সর্বাধিক পরিমাণ সুতি দ্রব্য এসময় বিদেশে রপ্তানি হতো বলে বিদেশী পর্যটকরা উল্লেখ করেছেন। সুলতানি আমলে ভারতে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ন্যায় বহির্বাণিজ্যেরও সম্প্রসারণ ঘটেছিল। জল এবং স্থল উভয় পথে তৎকালীন সময় বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, চীন এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলপথে এবং মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, পারস্য, তিব্বত ও ভুটান এর সঙ্গে স্থলপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল বাংলা ও গুজরাটের বন্দর। তুলা, আদা, চিনি, খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন রকমের মাংসের প্রাচুর্যের কারণে বিদেশী পর্যটক বারথেমা বাংলাকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মরক্কোবাসী মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতা সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে আগমন করেন। ইবনে বতুতার বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘রিহালা-ই-ইবনে বতুতা' নামক গ্রন্থে সুলতানি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা উল্লেখ করেছন। ইবনে বতুতার মতে, তখন বাংলায় ৩ টাকায় ১টি ভালো গরু এবং ১ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত । সুলতানি আমলে ভারতের গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর জন্য গ্রামের অধিবাসীদেরকে অন্যত্র যেতে হতো না ।
 

 

 


সুলতানি আমলে সামাজিক অবস্থা
সুলতানি আমলে ভারতের প্রধান হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করত। এ আমলে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক সংমিশ্রণের পথ নানাবিধ কারণে রুদ্ধ ছিল। ভারত জয় করার মাধ্যমে মুসলিমগণ সাম্রাজ্য স্থাপন করে নিজস্ব সংস্কৃতি লালন করতে শুরু করেন। অপরদিকে ভারতের স্থায়ী অধিবাসী হিন্দু সমাজেও রক্ষণশীলতা প্রসূত সংকীর্ণতা প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংমিশ্রণের পরিবর্তে পার্থক্যই বেশি পরিলক্ষিত হয়।
মুসলমান সমাজের অবস্থা
সুলতানি আমলে ভারতে মুসলমান সমাজ দু'টো শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা (১) অভিজাত শ্রেণি- যারা বিভিন্ন দেশ থেকে আগত এবং (২) সাধারণ শ্রেণি-স্থানীয় অধিবাসী যারা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত। অভিজাত শ্রেণী গঠিত হয়েছিল তুর্কি, ইরানি, তুরানি, আরব ও আফগানদের নিয়ে। এই অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে অনেকেই নিজেদেরকে শেখ, সৈয়দ, পাঠান ও গাজী প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করেন। অভিজাত শ্রেণি ছিল শাসক শ্রেণী। যারা ‘আশরাফ’ নামে পরিচিত ছিল। আর সাধারণ শ্রেণি ছিল শাসিত শ্রেণি। যারা ‘আতরাফ' নামে পরিচিত ছিল। দিল্লি সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে সাধারণত অভিজাত শ্রেণির মুসলমানদের নিয়োগ দেয়া হত। রাষ্ট্রীয় গুরত্বপূর্ণ পদ যেমন- আমির, উজির, কাজি, মুফতি, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, সেনাপতি প্রভৃতি পদে তারা নিযুক্ত হতেন। কোনো সুলতান মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে আন্ত:কোন্দল দেখা দিত। সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসুরীদের শাসনামলে অভিজাত শ্রেণি উপদ্রব শুরু করলে বাধ্য হয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ও সুলতান আলাউদ্দিন খলজি তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। দিল্লি সালতানাতের সর্বশেষ রাজবংশ লোদী বংশের শাসনামলে অভিজাত শ্রেণীর একটি দল কাবুলের অধিপতি জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। লোদী বংশের সর্বশেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।
হিন্দু সমাজের অবস্থা
মুসলমান শাসকগণ হিন্দুদের প্রতি যথেষ্ট উদার ও মানবিক ব্যবহার করতেন। ভারতে হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা (Caste system) প্রচলিত ছিল। জাতিভেদ নীতি দ্বারা আচ্ছন্ন হিন্দু সমাজে শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের প্রতি ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ও নির্যাতন চরম আকার ধারণ করেছিল। সুলতানগণ হিন্দুদেরকে জিম্মির মর্যাদা প্রদান করে তাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ ও উদার নীতি গ্রহণ করেন। দিল্লির সুলতানি শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত ও রাজকীয় উচ্চ পদে দায়িত্বপালন করত। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ও সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের নিয়োগ প্রদান করেছিলেন। মুসলিম শাসকরা সামরিক কার্য হতে অব্যাহতি দেওয়ার বিনিময়ে হিন্দুদের উপর জিজিয়া নামক এক ধরনের নিরাপত্তা কর আরোপ করেন। কিন্তু সামরিক কার্যে যোগদানকারীদের জিজিয়া প্রদান করতে হতো না। ব্যবসায় বাণিজ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে হিন্দুরাও মুসলমানদের পাশাপাশি সমানভাবে অংশগ্রহণ করত। দীর্ঘ সময় ধরে পাশাপাশি অবস্থানের ফলে সুলতানি আমলে ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ পরস্পরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। হিন্দুদের শিল্পকলা, স্থাপত্যবিদ্যা, ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ঐতিহ্য ও দর্শন মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করে ।
দাস প্রথা
সুলতানি আমলে ভারতে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। জিনিসপত্রের ন্যায় হাট-বাজারে দাস-দাসী বিক্রি হত। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে কুতুবউদ্দিন আইবেক, শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ এবং গিয়াসউদ্দিন বলবন প্রাথমিক জীবনে ক্রীতদাস ছিলেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ তাঁর বিশ্বস্ত ৪০ জন তুর্কি ক্রীতদাসের সমন্বয়ে ‘বন্দেগান-ই-চেহেলগান' প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে ৫০ হাজার এবং সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে ১,৮০,০০০ ক্রীতদাস ছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে প্রায় ৪০,০০০ ক্রীতদাস সুলতানের প্রাসাদে বসবাস করত। সুলতান এমনকি ক্রীতদাসদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘দিওয়ান-ই-বন্দেগাণ” নামক একটি নতুন বিভাগ স্থাপন করেন। নারীর অবস্থা
সুলতানি আমলে ভারতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজে নারীদেরকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হতো। প্রত্যেক ধর্মের লোকেরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসারে জীবনযাপন করতেন। অভিজাত পরিবারে মেয়েরা সাধারণত শিল্প ও
 

 

 

 


বিজ্ঞান চর্চা করতেন। গ্রামীণ রমণীরা গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত থাকতেন। পর্দা প্রথা মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত রমণীদের মধ্যেও দেখা যায়। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ এবং 'জহরব্রত প্রথা' হিন্দু সমাজে পালন করা হত। সুলতানি আমলে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস
সুলতানি আমলে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়কালে ভারতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরাট পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এ আমলে ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা হয়েছিল। এর ফলে মুসলমানদের সংস্কৃতি বহুলাংশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘকাল পাশাপাশি অবস্থানের ফলে মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতি ও ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতির মধ্যে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন ও সংমিশ্রণে পরস্পর প্রভাবের আদান প্রদানের ফলে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিম দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক জীবনে আচার-আচরণ, ধর্মকর্ম, ভাবভাষা, রীতি-নীতি নিয়মকানুন প্রভৃতির বিনিময় ঘটেছিল। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি হতে হিন্দু ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান শুধুই যে উপাদান গ্রহণ করেছিল এমনটি নয় বরং হিন্দু সংস্কৃতির প্রকৃতি এবং মানসিক গঠনেও পরিবর্তন এসেছিল, মুসলমানরাও জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সেই পরিবর্তনের ধারায় সমানভাবে সাড়া দিয়েছিল।
শিক্ষার্থীর কাজ
সুলতানি আমলে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস লিখুন।
সারসংক্ষেপ :
সুলতানি আমলে ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার ফলে মুসলমানদের সংস্কৃতি বহুলাংশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘকাল পাশাপাশি অবস্থানের ফলে মুসলিম সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ভারতীয় তথা হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরস্পর প্রভাবের ফলে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিম দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক জীবনে আচার-আচরণ, ধর্ম-কর্ম, ভাব-ভাষা, রীতি-নীতি নিয়মকানুন প্রভৃতির বিনিময় ঘটেছিল। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি হতে হিন্দু ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান শুধুই যে বিভিন্ন উপাদান গ্রহণ করেছিল এমনটি নয়; এমনকি হিন্দু সংস্কৃতির প্রকৃতি এবং মানসিক গঠনেও পরিবর্তন এনেছিল, মুসলমানরাও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই পরিবর্তনের ধারায় সমানভাবে সাড়া দিয়েছিল।
 

 

 

 


পাঠ-২.১৩
দিল্লি সালতানাতের পতনের কারণ
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
দিল্লি সালতানাতের অবক্ষয়ের প্রত্যেকটি কারণ আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন; দিল্লি সালতানাতের পতনের সামগ্রিক কারণ সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন।
বন্দেগান-ই-চেহেলগান, দিওয়ান-ই-বন্দেগান ও পানি পথের যুদ্ধ
মূখ্য শব্দ
দিল্লি সালতানাতের পতন
১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের পর ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘুরের অধিপতি মুইজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ওরফে মুহম্মদ ঘোরি পৃথ্বীরাজ চৌহান-এর নেতৃত্বে পরিচালিত সম্মিলিত বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। মুহম্মদ ঘোরি গজনীতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে তাঁর সুযোগ্য এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেককে ভারতবর্ষের বিজিত অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে অপুত্রক অবস্থায় মুহম্মদ ঘোরি মৃত্যুবরণ করলে কুতুবউদ্দিন আইবেক মুহম্মদ ঘোরি ভ্রাতুষ্পুত্র ও ঘুর রাজ্যের অধিপতি গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ কর্তৃক ‘সুলতান’ উপাধি এবং মুক্তির ছাড়পত্র লাভ করে এবং দিল্লি সালতানাতের প্রথম সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করে তথাকথিত দাস বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। মামলুক বংশ (দাস বংশ), খলজি বংশ, তুঘলক বংশ, সৈয়দ বংশ এবং লোদী বংশ এই পাঁচটি রাজবংশ ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লি সালতানাতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক বংশের পতনের সাথে সাথেই তুর্কি সাম্রাজ্য অর্থ্যাৎ দিল্লি সালতানাত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। তুঘলক বংশের পর সৈয়দ ও লোদী বংশ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুলতানি শাসন পরিচালনা করেছিল। অবশেষে লোদী বংশের দুর্বল শাসক ইব্রাহিম লোদীর দুর্বলতার সুযোগে কাবুলের অধিপতি জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে এবং দিল্লি সালতানাতের অবসান ঘোষণা করে ভারতবর্ষে মুঘল বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
দিল্লি সালতানাতের পতনের কারণসমূহ: সুলতানদের স্বেচ্ছাতন্ত্র
ভারতীয় উপমহাদেশে দিল্লির সুলতানদের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাতন্ত্রের উপর শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুলতান ছিলেন রাজ্য শাসনের সর্বশক্তি ও ক্ষমতার উৎস। সুলতানদের নিজস্ব ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের উপর দিল্লি সালতানাতের স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল ছিল। শক্তিশালী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুলতানদের শাসনামলে সাম্রাজ্যব্যাপী সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হতো এবং সর্বত্র নিয়ম-কানুন মেনে চলা হতো। কিন্তু দুর্বল ও অকর্মণ্য শাসকদের শাসনামলে সাম্রাজ্যব্যাপী বিদ্রোহ ও অরাজকতা বিরাজমান থাকত। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক, শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ, গিয়াসউদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খলজি ও ফিরোজ শাহ ব্যতীত দিল্লির অধিকাংশ সুলতান ছিলেন দুর্বল, অযোগ্য ও অকর্মণ্য। এসমস্ত দুর্বল সুলতানদের শাসনামলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ, বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল ।
সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব
সুলতানি আমলে ভারতে কোন সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতি ছিল না। ফলে সালতানাতকে কেন্দ্র করে গোলযোগ দেখা দিত। সিংহাসনের দাবীকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব গৃহ-বিবাদ, অন্তর্কলহ, বিদ্রোহ ও হত্যাকান্ড প্রভৃতি সংঘটিত হওয়ার কারণ সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতির অভাব। দিল্লি সালতানাতের উত্তরাধিকারী নির্বাচনে অভিজাত শ্রেণী হস্তক্ষেপ করত। সুলতানদের উত্থান-পতনে তাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
 

 

 



প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা স্পৃহা
দিল্লি সালতানাতের পতনের অন্যতম কারণ প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতাস্পৃহা। তুর্কি-আফগান শাসনামলে দিল্লির অধীনস্ত প্রাদেশিক শাসকগণ নিজ নিজ প্রদেশে ছিলেন সব ক্ষমতার অধিকারী। কেন্দ্রিয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ প্রায়শই বিদ্রোহ করতেন এবং মাঝে মাঝে স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। দুর্বল ও অযোগ্য সুলতানদের শাসনামলে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ বিভিন্ন প্রদেশে গোলযোগ সৃষ্টি করতেন।
সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতা
দিল্লির সুলতানগণ ছিলেন অতিমাত্রায় সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। এর ফলে প্রজাসাধারণের স্বাভাবিক আনুগত্য ও জাতীয়তাবোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছিল। শাসন ব্যবস্থায় জনগণের নির্লিপ্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। সামরিক বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। সামরিক শক্তি নির্ভর দিল্লি সালতানাত বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি।
সাম্রাজ্যের বিশালতা
দিল্লি সালতানাত সমগ্র উত্তর ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের বেশ কিছু অংশে বিস্তৃত ছিল। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির শাসনামলে দিল্লি সালতানাতের আয়তন বিশাল আকার ধারণ করে। বিশাল সাম্রাজ্যে উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে বাংলা ও দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝে মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিত। শক্তিশালী ও সুদক্ষ সুলতানগণ এসকল বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হলেও অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতা সম্পন্ন এবং অদক্ষ সুলতানদের শাসনামলে এসকল বিদ্রোহ দমন ছিল প্রায় অসম্ভব।
অভিজাত শ্রেণির দৌরাত্ম
অভিজাত শ্রেণীর দৌরাত্ম ও দিল্লি সালতানাতের পতনে ভূমিকা পালন করেছিল। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের পৌত্র কায়কোবাদের শাসনামলে তাঁর উজির নিজামউদ্দিনের কুশাসন, আলাউদ্দিন খলজির দুর্বল উত্তরাধিকারীদের শাসনামলে মালিক কাফুরের নির্যাতন, দুঃশাসন এবং কট্টরপন্থী খসরু খানের অপশাসন প্রভৃতির ফলে সাম্রাজ্যে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সূচিত হয়েছিল। এর ফলে সালতানাতের অন্তর্নিহিত শক্তির অবক্ষয় ঘটেছিল ।
মুহম্মদ বিন তুঘলকের উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রসূত পরিকল্পনা
সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী এবং যুগের চেয়েও অগ্রগামী শাসক। তাঁর অবাস্তব আদর্শবাদিতা, উচ্চাকাঙ্খা প্রসূত ব্যর্থ পরিকল্পনা প্রভৃতির ফলে দিল্লি সালতানাতের সংহতি ও অভ্যন্তরীণ শক্তি দুর্বল হতে থাকে। তাঁর শাসনামলে কেন্দ্রিয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে দাক্ষিণাত্য, বাংলা ও সিন্ধু প্রদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন একজন উদার ও ধার্মিক শাসক। দিল্লি সাম্রাজ্যের পূর্বের গৌরব পুনরুদ্ধার করার মত শক্তি তাঁর ছিল না । বলা হয়ে থাকে যে, জায়গীর প্রথার পুনঃপ্রবর্তন, উত্তরাধিকারসূত্রে সামরিক পদ লাভ, অযৌক্তিক উদারতা প্রদর্শন এবং ক্রীতদাস প্রথা প্রবর্তন করে তিনি দিল্লি সালতানাতের পতনের পথ প্রশস্ত করেছিলেন।
নৈতিক অধ:পতন
দিল্লি সালতানাতের শেষ পর্বের সুলতানগণ ও অভিজাতশ্রেণীর নৈতিক স্খলন সালতানাতের পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল। অধিকাংশ সুলতান মদ, নারী ও বিলাসিতায় ডুবে থাকার ফলে একজন আদর্শ রাষ্ট্র নায়কের মহান গুণাবলী ছিল তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। রাষ্ট্রনায়কের তেজস্বিতা, কর্মক্ষমতা ও সাহস হারিয়ে ফেলার কারণে সাম্রাজ্যের ভিত ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে। সুলতান, অভিজাতশ্রেণী এবং রাজকর্মচারীদের উচ্ছৃঙ্খল ও বিলাসী জীবন যাপনের ফলে দিল্লি সালতানাত ক্রমাগতভাবে অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়েছিল।
ক্রীতদাস প্রথার কুফল
দিল্লির সুলতানগণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ক্রীতদাস প্রথা বিদ্যমান রেখেছিলেন। ক্রীতদাসদের মধ্য থেকে কয়েকজন পরবর্তীতে সুলতানের মর্যাদাও লাভ করেছিলেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ তাঁর বিশ্বস্ত ৪০ জন ক্রীতদাসদের নিয়ে ‘বন্দেগান-ই-চেহেলগান' বা 'চল্লিশ চক্র' গঠন করেছিলেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন এই চল্লিশ চক্রের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য। তিনি সুলতান হিসেবে দায়িত্ব লাভের পর চল্লিশ চক্রের কিছু সদস্য তাঁর বিরোধিতা করেছিল। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ক্রীতদাসদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘দিওয়ান-ই-বন্দেগাণ' নামক একটি নতুন বিভাগ স্থাপন করেন।

 

 

 

 


তাঁর শাসনামলে ক্রীতদাসদের সংখ্যা প্রায় ১,৮০,০০০ এ উন্নীত হয়েছিল। এই বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাসদের ভরণ- পোষণের জন্য রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হতো। তদুপরি ক্রীতদাসদের মধ্যকার অন্তর্কলহ ও বিবাদের ফলে দিল্লি সালতানাত পতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল।
অমুসলিমদের বিরোধীতা
ভারত ছিল একটি হিন্দু অধ্যুষিত দেশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ ও বৈরী মনোভাব এবং অমুসলিম প্রজাবর্গের প্রতিবন্ধকতার ফলে দিল্লি সালতানাতের পতন ঘনীভূত হয়েছিল। উত্তর ভারতের রাজপুত শক্তি এবং দাক্ষিণাত্যের হিন্দু সম্প্রদায় পরিস্থিতি অনুকুল পেলেই দিল্লি সুলতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে কুণ্ঠিত হতো না। কোন কোন সুলতান হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ প্রদান এবং স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের অধিকার প্রদান করলেও রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম শাসন মনে প্রাণে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না।
তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ
ভারতবর্ষের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ত্রাস ও দিগ্বিজয়ী বীর তৈমুর লঙ ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে দিল্লি দখল করেন। তিনি দিল্লিতে ১৫ দিন লুণ্ঠন, ধ্বংস এবং ১,০০,০০০ নিরীহ অধিবাসীকে হত্যা করে সিরি, পুরাতন দিল্লি, জাহানপানাহ, ফিরোজাবাদ, মীরাট, হরিদ্বার, নগরকোট প্রভৃতি স্থানেও ব্যাপক হত্যাকান্ড ও লুণ্ঠন করেন। দিল্লি সালতানাতের পতনোম্মুখ সময়ে তৈমুরের ভারত আক্রমণ এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ও নজিরবিহীন লুণ্ঠন সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের মূলে কুঠারাঘাত করেছিল।
বাবরের আক্রমণ ও সালতানাতের পতন
দিল্লি সালতানাতের সর্বশেষ রাজবংশ লোদী বংশের সর্বশেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীর উদ্বত আচরণ ও কঠোর দমন নীতির ফলে অসন্তুষ্ট আফগান অভিজাত শ্রেণি, পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদী এবং ইব্রাহীম লোদীর পিতৃব্য আলম খান এবং মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ কাবুলের অধিপতি জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবরকে ভারত আক্রমণের আহবান জানান। উচ্চাভিলাষী এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর বাবর এই আহবানে সাড়া দিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের সর্বশেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত ও নিহত করে ভারতর্ষে মুঘল শাসনের গোড়াপত্তন করেন।
শিক্ষার্থীর কাজ দিল্লি সালতানাতের পতনের কারণগুলো লিখুন।
সারসংক্ষেপ :
ইব্রাহিম লোদীর উদ্যত আচরণ ও কঠোর দমন নীতির ফলে অসন্তুষ্ট আফগান অভিজাত শ্রেণি, পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদী এবং ইব্রাহীম লোদীর পিতৃব্য আলম খান এবং রাজপুতনার মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহ কাবুলের অধিপতি জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবরকে ভারত আক্রমণের আহ্বান জানান। উচ্চাভিলাষী এবং সাম্রাজ্যবাদী বাবর এই আহবানে সাড়া দিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী | বংশের সর্বশেষ শাসক ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লি সালতানাতের পতন ঘোষণা করেন এবং ভারতর্ষে মুঘল শাসনের গোড়াপত্তন করেন।
 

Content added By
Promotion